বন্দুক, তুমি যুদ্ধ বোঝো তদন্ত বোঝো না?
আল আমিন আনাম : মাদারীপুরে শিক্ষক হত্যাচেষ্টায় গ্রেফতার ফয়জুল্লাহ ফাহিম রিমান্ডে থাকা অবস্থায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। গতকাল শনিবার ফেসবুকে এ প্রসঙ্গে সাপ্তাহিকের সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা লিখেছেন, রাজনৈতিক বক্তৃতায় যে কাউকে অভিযুক্ত করা যায়। নিজেরা ধরতে পারি না, জনগণ ধরে দেয়। তাদের ক্রসফায়ারে বা বন্দুক যুদ্ধে হত্যা করা হয়। এমন একটি হত্যাকা- যে ঘটতে যাচ্ছে, অভিযানের ধরনে তা প্রত্যাশিতই ছিল।
তিনি আরও লিখেছেন- কারা জঙ্গি, কারা তৈরি করে, কারা পৃষ্টপোষক, কারা জঙ্গি-গুপ্তহত্যা টিকিয়ে রেখে সুবিধা পেতে চায়Ñ সব প্রশ্নের উত্তর আছে এই একটি হত্যাকা-ের মধ্যে। ফেসবুকে দেওয়া গোলাম মোর্তোজার এই স্ট্যাটাসে বিনু মাহবুবা লিখেছেন, যাদের কাছেই তথ্য থাকে তারাই বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। বিষয়টি নিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘একদিকে সরকার নিজ দলীয় সিরিয়াল খুনিদের ফাঁসিসহ সকল সাজা মওকুফ করে দিয়ে জেল থেকে মুক্ত করছে, অন্যদিকে জনতার হাতে ধরাপড়া টার্গেট কিলারদের খুন করে সব প্রমাণ আড়াল করছে! তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? এর নাম কি ন্যায়বিচার? এটাই কি ৩০ লাখ মানুষের রক্তে অর্জিত আমার মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ।’
ইমরান লিখেন, ‘খুন যেই করুক না কেন, সে খুনি। জঙ্গি করুক, সন্ত্রাসী করুক কিংবা রাষ্ট্র করুক; সে খুনি। এখানে তবে-কিন্তুর কোনো অবকাশ নেই। একজন বোধ-বিবেচনা সম্পন্ন মানুষের কোনো খুনই সমর্থনের সুযোগ নেই। কোনো খুনি কিংবা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এদেশের ৩০ লক্ষ মানুষ আত্মত্যাগ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে খুনি কিংবা নিপীড়ক রাষ্ট্র নয়। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে পরিষ্কারভাবেই ন্যায়বিচারের কথা বলা হয়েছে।
ক্রসফায়ারে ফাহিমের নিহত হওয়ার বিষয়টিকে অবিচার বলে ইমরান লিখেন, একজন খুনিকে হত্যার মধ্যদিয়ে সবচেয়ে বেশি অবিচার করা হয় খুন হওয়া মানুষগুলোর স্বজনদের সাথে। কেননা, অপরাধীকে খুনের মাধ্যমে পরিবারটির ন্যায়বিচার পাওয়ার আর কোনো সম্ভাবনাই থাকে না।
হাতেনাতে আটক হওয়া খুনিকে হত্যার আরও গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, এইসব খুনির বিরুদ্ধে প্রমাণ থাকে এবং ন্যায়বিচার পাওয়া সহজ হ্য়। বরং এইসব ক্ষেত্রে চলমান হত্যাকা-ের রহস্য উদঘাটনের সুযোগ থাকে। তাহলে প্রশ্ন আসে ঠিক কি কারণে তাহলে এমন অপরাধীকে হত্যা করা হলো? কাকে আড়াল করতে এই হত্যাকা-?
ফাহিমের মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন চলচ্চিত্র ও নাট্য নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
শনিবার সকালে নিজের ফেসবুকে ‘বন্দুক, তুমি যুদ্ধ বোঝো, তদন্ত বোঝো না?’ শিরোনামে লেখা ওই পোস্টে তিনি বলেছেন, যেখানে এই আক্রমণের হাত থেকে আস্তিক-নাস্তিক, সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু, নারী-পুরুষ, সিভিলিয়ান পুলিশ কেউই ছাড় পাচ্ছিল না, যেখানে এটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছিল এবং আমরা কোনো বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের আলামত দেখছিলাম না, সেখানে মাদারীপুরের মানুষ এক আসামি হাতেনাতে ধরে ফেলার পর আশা করছিলাম ভেতরের কলকাঠির সুলুক সন্ধান করা হবে। সেই স্থলে এই বন্দুকযুদ্ধের কি মানে?
ফারুকী তার ফেসবুকে লিখেছেন, যদিও আমি জানি এই শব্দ ব্যবহারের তাৎপর্য কি, তবুও সংখ্যালঘু শব্দটা কেন জানি আমি নিতে পারি না। সরাসরি হিন্দু বা অন্য যে পরিচয় আছে সেটা লিখলে কি ক্ষতি? আমার কোনো বন্ধুরে লঘু ভাবতে আমার খুবই আপত্তি হয়।
তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমাদের কোনো হিন্দু বন্ধুরে আমরা কখনও লঘু হিসেবে দেখছি বলে মনে পড়ে না। এই ভাবা বা ডাকার মধ্যেই আমি ঝামেলা পাই। আমার মনে হয় এর মধ্য দিয়ে আমি আমার মতোই একজনকে চাপ দিয়ে ছোটো বানাইয়া দিচ্ছি। আমি তখন আর তার চোখের দিকে তাকাইয়া কথা বলতে পারি না।
মুক্তমনা বাংলা ব্লগার ফারজানা কবির খান তার ফেসবুকে ভিডিও কলে বলেন, কেন খুন করা হলো ফাহিমকে? কেন একজন মানুষকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয় না। কেন বলতে দেওয়া হলো না কারা তাকে জঙ্গি বানিয়েছে।
তিনি বলেন, হোক ফাহিম জঙ্গি কিন্তু কেন তাকে বন্দুক যুদ্ধে মারা হলো। কেন তাকে সবার সামনে আসতে দেওয়া হলো না। কেন তাকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হলো না। সে মুখ খুলতে শুরু করছিল আর তখনি তাকে ক্রসফায়ারের নামে গুলি করে মেরে ফেলা হলো। এর মানে বোঝার কারও বাকি নেই।
প্লিজ আপনারা জেগে উঠুন, আপনারা কথা বলুন। তা-না হলে একদিন সবাই তার আত্মীয় কিংবা সন্তানকে এভাবে হারাবেন। দেশটাকে আমরা সবাই মিলে নষ্ট করছি। আমরা প্রতিবাদ করতে জানি না। আমাদের দেশকে মেরে ফেলার জন্য আমরাই দায়ী।