বাংলাদেশে ‘ব্যাপক দমন অভিযান’ প্রশ্ন তুলছে
মমিনুল ইসলাম: ইসলামি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে দমন অভিযান ঘোষণা করার মাত্র ছয় দিনের মধ্যে ১১,৬০০ নতুন বন্দি দিয়ে কারাগার পরিপূর্ণ করে ফেলেছে বাংলাদেশ। এটাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অত্যাশ্চর্য প্রদর্শন বলে মনে করা যেতে পারে। সমস্যা হচ্ছে এ আটককৃতদের মধ্যে দুই ভাগেরও কম ব্যক্তি সন্দেহভাজন মৌলবাদী। তাও আবার এদের একজনকেও অতিমাত্রার সক্রিয় বলে মনে করা হয় না। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।
বাকিদের বেশিরভাগই চুরি, ডাকাতি বা স্বল্পকালীন মাদক চোরাচালানে অভিযুক্ত। প্রধান বিরোধীদল বিএনপির তথ্য মতে, আটককৃতদের মধ্যে তাদের কমপক্ষে ২০০০ সদস্য রয়েছে। আর বাকিরা বিএনপির প্রধান মিত্র জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে মনে করা হয়।
বর্তমানে এ দমন অভিযান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষক, মানবাধিকার গ্রুপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের প্রতিপক্ষরা। তাদের প্রশ্ন- এ অভিযান কি আসলেই বিভিন্ন সংখ্যালঘুদের উপর মুসলিম উগ্রপন্থিদের নির্লজ্জ, প্রাণঘাতী সিরিজ হামলা থামানোর প্রচেষ্টা, নাকি সংঘটিত হত্যাকা- থেকে সরকারের দেশে ও বিদেশে রাজনৈতিক সুবিধা লাভের প্রয়াস?
ওয়াশিংটন ডিসির হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ লিসা কার্টিস বলেন, উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে দমন অভিযান প্রয়োজন রয়েছে। তিনি জানান, পুলিশের তথ্য মতে হাজার হাজার আটককৃতের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে সন্দেহভাজন মৌলবাদী মাত্র ১৭৭ জন। তাই এ গণগ্রেফতারকে হামলা বন্ধ করার একটি গুরুতর প্রচেষ্টার চেয়ে বিরোধী দলকে চাপে রাখার একটি হাতিয়ার বলে মনে করেন তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এমন অভিযান প্রকৃতপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের সমর্থক ও দীর্ঘদিনের ইসলামি শাসন প্রত্যাশীদের মাঝে বিভক্তি আরও গভীর করবে। এমনকি এটা জঙ্গিদের আরও উৎসাহিত করতে পারে বলে অভিমত তাদের।
কার্টিস বলেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা অধিক পরিমাণে সদস্য সংগ্রহ ও প্রভাব বিস্তারে ইসলামি উগ্রবাদীদের জন্য দরজা উম্মোচন করে দিচ্ছে। সেই সাথে এটা বাংলাদেশে উগ্রবাদের বিরুদ্ধে একটি জাতীয় ঐকমত্য গঠনে সরকারের জন্য জটিলতা সৃষ্টি করবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
২০১৩ সাল থেকে প্রায় দুই ডজন নাস্তিক লেখক, প্রকাশক, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, সমাজকর্মী ও বিদেশি ত্রাণকর্মী হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন। তাই দমন অভিযান নিয়ে সমালোচনার উত্তরে এসব হত্যাকা-ে দায়ী সন্দেহভাজন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা অভিযান পরিচালনার কথাই পুনর্ব্যক্ত করছে সরকার। এ হত্যাকা-ের বেশিরভাগই সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ঘটেছে।
তথাকথিত চাপাতি হামলা দেশের সংখ্যালঘুদের আতঙ্কগ্রস্ত করেছে। পাশাপাশি তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের জন্য সতর্কতার সূত্রপাত ঘটিয়েছে। ইতিমধ্যে এসব দেশের কিছু সরকার ঝুঁকিপূর্ণদের আশ্রয় দেয়ার প্রস্তাব দেয়া শুরু করেছে। বেশিরভাগ হত্যাকা-ে দেখা গেছে একদল যুবক তাদের ভুক্তভোগীদের মাংস কাটা ছুরি ও রামদা দিয়ে কুপিয়েছে। অত:পর ঘটনাস্থল ছেড়ে পালিয়েছে তারা।
এদিকে অধিকাংশ হত্যাকা-ের ঘটনায় হয় ইসলামি স্টেট অথবা আল কায়েদার অঙ্গ শাখা দায় স্বীকার করেছে। তবে সরকার উভয় বহুজাতিক জিহাদি গ্রুপের বাংলাদেশে বিদ্যমান থাকার বিষয়ে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে।
বরং এ ঘটনায় হাসিনা সরকার স্থানীয় সন্ত্রাসী ও ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোকে অভিযুক্ত করছে। বিশেষত সরকার প্রধান বিরোধীদল বিএনপি ও এর মিত্র জামায়াতে ইসলামকে দায়ী করছে। সরকারের অভিযোগ, সরকার উৎখাতের উদ্দেশ্যে এটা পরিকল্পিত সহিংসতা। অন্যদিকে, প্রধান দুই বিরোধীদল এসব ঘটনায় যেকোনো ধরনের সম্পৃক্ততাকে অস্বীকার করেছে।
গুলি ও ছুরিকাঘাতে এক পুলিশ সুপারের স্ত্রী নিহত হওয়ার পর গত সপ্তাহে হাসিনা সরকার এ অভিযানের ঘোষণা দেয়।
তবে পুলিশ এখন বলছে, দমন অভিযানে কেবলমাত্র মৌলবাদীদের টার্গেট করা হয়নি। মাদক ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবসায় অভিযুক্তদের ধরতেও এ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। পুলিশ মুখপাত্র কামরুল আহসান বলেছেন, জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সঙ্গে একত্রেই এ ‘বিশেষ অভিযান’ পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত গণমাধ্যমকে এ বিষয়টি জানানো হয়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
গত শুক্রবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ ) এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশের উচিত জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা। সেই সাথে যথাযথ প্রমাণ ছাড়া নির্বিচার গণগ্রেফতার অবিলম্বে বন্ধ ও যারা অভিযুক্ত নয় তাদের ছেড়ে দেয়া উচিত বলে জানায় সংগঠনটি।
এইচআরডাব্লিউ এর এশীয় অঞ্চলের পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস অভিযোগ করেন, এসব ভয়ঙ্কর আক্রমণের ঘটনায় ধীর গতি ও আত্মতুষ্টির প্রতিক্রিয়া দেখানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী পুরানো অভ্যাসে ফিরে গেছে। তারা ঘটনার যথাযথ তদন্তের পরিবর্তে ‘স্বাভাবিক সন্দেহভাজনদে’র ধরপাকড় করছে।
আটকদের বেশিরভাগ শুক্রবার পর্যন্তও পুলিশ হেফাজতে ছিল। তাদের জামিন বা নিরাপদ করতে পুলিশ স্টেশন, আদালত ও কারাগারে ভিড় করছেন পরিবার ও বন্ধুরা। স্থানীয় গণমাধ্যমের তথ্য মতে, পুলিশকে এজন্য ঘুষও দিচ্ছেন তারা।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া ব্যুরো চলতি সপ্তাহে ইসলামী উগ্রবাদ নির্মূলে বাংলাদেশকে সাহায্য করার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে। পাশাপাশি তদন্তে স্বচ্ছতা ও সুষ্ঠু বিচারের পরামর্শ দিয়েছে।
বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেন, সম্ভবত দেশে নিরাপত্তা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ প্রশমনের লক্ষ্যেও এ অভিযান পরিচালনা করা হতে পারে।
ওয়াশিংটন ডিসির রান্ড করপোরেশনের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিজ্ঞানী জোনাহ ব্লাঙ্ক বলেন, দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষরা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ফৌজদারি অপরাধীদের একত্রে মিশিয়ে ফেলার প্রবণতা গ্রহণ করেছেন। তাই আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, এখানে বেশি বেশি পেশাদার দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।
বিরোধীদল ক্ষমতায় থাকাকালীন কর্মরত থাকা এক সাবেক পুলিশ প্রধান বলছেন, সরকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঢাকতেই অভিযান পরিচালনা করছে। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পুলিশ মহাপরিদর্শক ছিলেন নুর মোহাম্মাদ। তিনি বলেন, খুনীদের আটক ও হামলা বন্ধে পূর্ণ প্রচেষ্টা ররেছে তা দেশবাসী ও বিদেশি সম্প্রদায়কে দেখাতেই এ অভিযান পরিচালনা করছে পুলিশ। সাধারণত কোনো ভিত্তি ছাড়াই এমন অভিযান চালু করা হয় এবং বহু সংখ্যক নির্দোষ মানুষ আটক করে হয়রানি করা হয়।
বিএনপি কর্মকর্তারা বলছেন, নিরাপত্তা পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলায় মানুষের মনোযোগ অন্যদিকে ফেরাতে হত্যাকা-ের ঘটনায় তাদের দোষারোপ করছে হাসিনা। তারা আরও অভিযোগ করছেন, হাসিনা তার সমর্থনে চ্যালেঞ্জ প্রতিরোধ করতেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করছে।
বিএনপির লন্ডনভিত্তিক মুখপাত্র হুমাউন কবির বলেন, হাসিনা ভয়ঙ্কর খেলা খেলছেন। গণতান্ত্রিক বিরোধীদের নির্মূলের জন্য দমন অভিযান ব্যবহার করছেন। এতে জঙ্গিদের নিজ রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ জোরদারের পথ পরিষ্কার হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। সম্পাদনা : রাশিদ রিয়াজ