
টার্গেট কিলিংকে টার্গেট করুন
গুপ্তহত্যা নতুন বিষয় নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি বিশেষ ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অতিমাত্রায় এর ব্যবহার শুরু করেছে। গোপনে হত্যার মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করাই এর মূল উদ্দেশ্য। নীতিভ্রষ্ট কিছু ধর্মীয় লেবাসধারী দেশে খেলাফত আন্দোলন প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর হয়ে একের পর এক নিরীহ সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে হত্যা করে চলেছে। তাদের এই ধরনের কর্মকা-কে কোনো অবস্থায় সমর্থন করা যায় না। কারণ কোনো ধর্মই অহেতুক মানুষ হত্যা সমর্থন করে না।
প্যালেস্টাইনে যখন রোমান শাসন অব্যাহত ছিল, তখন জিলটরা রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করে। ৬৬-৭০ খ্রি. রাজনৈতিক আন্দোলনটি মূলত ছিল রোমানদের বিরুদ্ধে। তাদের পবিত্রভূমি থেকে রোমানদের বিতাড়নের জন্যে এই আন্দোলন পরবর্তীতে সশস্ত্র আন্দোলনের রূপ নেয়। এই জিলটদের একটি শাখা ছিল ‘সিকারিই’ যারা শুধু রোমানদেরকেই নয়, উদার ধর্মীয় নীতিতে বিশ্বাসী যারা তাদেরকেও গুপ্তহত্যা চালাত। তারা আল খেল্লার ভিতরে ‘সিকে’ নামক ছোট চাকু বা ছুরি রেখে জনসমাবেশের ভিতর রোমানদের বুকে বসিয়ে দিত। ইতিহাসে ‘সিকারিই’রাই প্রথম রাজনীতিতে গুপ্তহত্যার প্রচলন করে।
প্রাচীন ভারতেও গুপ্তহত্যার প্রচলন ছিল। মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনামলে রাজ দার্শনিক কৌটিল্যের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্রে’ এই গুপ্তহত্যার উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীনকাল বা মধ্যযুগীয় সময়ে গুপ্তহত্যার সঙ্গে বর্তমান সময়ের গুপ্তহত্যার উদ্দেশ্য ও কার্যপদ্ধতির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। দেশের বর্তমান টার্গেট কিলিং বা গুপ্তহত্যার শিকার হওয়া নিরীহ মানুষগুলো কখনও মুক্তচিন্তার লেখক, প্রকাশক, পুরোহিত, দর্জি, সেবক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। আবহমান কাল ধরে এদেশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান মানুষগুলো একে অপরের সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে সমাজে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে। বিপদে আপদে একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় এসেছিল এই অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্য দিয়ে।
পূর্বেই ধারণা করা হয়েছিল, আইনশৃঙ্খলা অবনতি ঘটিয়ে পরাজিত শক্তি তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য এ ধরনের টার্গেট কিলিং অবলম্বন করে অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি করবে। উদ্দেশ্য, বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের উদার ধর্মীয় নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে দেশটির পরিচিত আছে তার মূলে আঘাত করে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়া। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়েও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ এর বিরোধিতা করেছে। সেই বিরোধিতাকারী গোষ্ঠী সবসময়ই পরাজিত হয়েছে। তাদের পরাজয়ের গ্লানি, অসম্মান এবং ঘৃণার ভিতর থেকে তারা আবার নবউদ্যমে ষড়যন্ত্রের বীজবপন করেছে।
দেশের জনগণ তাদের কোনো অবস্থায় সমর্থন করে না। তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর বিভেদের সুযোগে বিভিন্ন নামে ধর্মযুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে। তাদের মতাদর্শের বাইরের মানুষগুলোকে শত্রু মনে করে তাদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করবার ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। জঙ্গিগোষ্ঠীর এই ধরনের অপতৎপরতাকে জিরো টলারেন্স দেখানোই সরকারের উচিত বলে মনে করি।
জঙ্গিগোষ্ঠী সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি পালন করা উচিত। পাড়া-মহল্লাতে জঙ্গিবিরোধী কমিটি গঠন করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের ভিতর যখন প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী নিরীহ মানুষেরা গুপ্ত ঘাতকের শিকার হচ্ছে, সেই মুহূর্তে বিপুল পরিমাণ অবৈধ বিদেশি মুদ্রাসহ পাকিস্তানি নাগরিকের আগমন ও পুলিশকর্তৃক আটক হওয়ার ঘটনাসমূহ অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। এদেশে জঙ্গি তৎপরতায় সন্দেহজনক আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া দেশসমূহের নাগরিকদের এদেশে আগমনের উদ্দেশ্য ও তাদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখতে হবে। অতএব, সাধু সাবধান!
লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা, জাবি
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন
