
বাবার জন্য ভালবাসা
বাবা দিবস। ফেসবুকে ছেয়ে গেছে অনেক লেখা, বাবার সঙ্গে অনেকের অনেক ছবি। বাবাকে ঘিরে অনেকের অনেক অভিব্যক্তি। অনেক স্মরণ। অনেক শ্রদ্ধায় ভরা, মর্মস্পর্শী সেসব লেখা। অনেক লেখা পড়ে আমার চোখের পানি চলে আসছে।
লেখাগুলো পড়তে পড়তে আমার বাবাকে ‘শ্রেষ্ঠ বাবা’র অভিধা দিতে চাই না। কোনোভাবেই শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে তাকে অন্য বাবাদের সঙ্গে আলাদা করতে চাই না। তবে জীবন পাঠে আমার বাবা অনন্য, এটা সঙ্কোচহীনভাবে বলতে চাই। বাবা সাদামাটা একজন মানুষ, একদমই আটপৌরে তার জীবন। কষ্টের জীবন। তার বাবা, মানে আমার পিতামহ সেকালে এতো প্রভাবশালী-ধনবান হলেও তিনি পড়ালেখা করেছেন জায়গির থেকেই। তার প্রতিষ্ঠার জীবনটা ছিল একাকী। বাবার সরলতা-তার বিশ্বাসী আচরণগুলো একদমই শিশুদের মতন। বাবার সঙ্গে প্রতিদিন আমাদের ভাই-বোনদের টকশো হয়, সেখানে অনেক তর্ক হয়, অনেক কথায় কাটাকুটি হয়। মাঝে মাঝে তাতে তিনি সংক্ষুব্ধ হন। রাজনৈতিক মতাদর্শে পার্থক্য থাকায় খুনসুটিটা তার সঙ্গে আমার বেশি হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তিনি সোচ্চার, আমিও। আমার কয়েকটি বই প্রকাশিত হলেও আমার লেখা বা ওইসব বইয়ের ব্যাপারে তার আগ্রহ ছিল না। কিন্তু দুই বছর আগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত কলামসমগ্র নিয়ে লেখা-অলেখা বইটি তিনি পড়েছেন। এ বইটার ব্যাপারে তার প্রশংসা দেখলাম।
তিনি জানেন না, আমরা তাকে কতটা ভালোবাসি। আমরাও কখনও তাকে দেখাইনি এ ভালোবাসাগুলো। এসব বিষয়গুলোতে আমাদের প্রকাশভঙ্গি খুব কম। বাবা আমাদের গড়েছেন, মানুষ হয়ে ওঠার জন্য প্রতিদিন একটু একটু গড়েছেন। বাবা এখনও বলেন, মানুষের জন্য ‘মানুষ’ হতে হবে। বড়দেরকে সম্মান-শ্রদ্ধা করা এগুলোতো শিখেছি তার কাছ থেকে। তার কর্মনিষ্ঠার একটি কথা খুব আলোড়ন তোলে আমাদের। বিগত শতাব্দীর ৯১ সালে উপকূলীয় দক্ষিণ অঞ্চলে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল। সে সময় বাবা চট্টগ্রামে একটি ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন। ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাংকটির অফিস পানিতে তলিয়ে যায়। আমরাও তখন নোয়াখালীতে আক্রান্ত। কিন্তু আমাদের কথা না ভেবে তিনি অনেকটা ঝুঁকি-সাহস করে দ্রুততার সঙ্গে ব্যাংকটি সচল করেন। এজন্য তিনি ব্যাংককর্তৃক পুরস্কৃত হয়েছেন। সারাজীবন আমাদের চাইতে তিনি তার অফিস, তার কর্মস্থলকে ভালোবেসেছেন বেশি। খুব কম তিনি ছুটি নিয়েছেন। এ নিয়ে আমাদেরকে কোনো দুঃখ নেই। এটা আমাদেরকে প্রাণিত করে। তিনি তোষামোদ করতে পারেন না, এজন্য তিনি তার প্রাপ্যযোগ্য সম্মানটুকু পাননি।
কখনোই জিততে চাননি বলেই কখনও হারেনওনি। আশেপাশের সবাই জিতে যাচ্ছে, এই ব্যাপারটা বাবার মতো এতটা খুশি মনে সারল্য নিয়ে আর কাউকে কখনও বলতে শুনিনি। আজকের দিন পর্যন্ত কোনো ব্যাপার নিয়েই বাবাকে কখনও আফসোস করতে দেখিনি। জীবনের হিসাব মেলানোর চেষ্টাও করেননি কোনোদিন, তবুও সব হিসাব মিলে গেছে নিখুঁতভাবে। খুব উঁচুতে পৌঁছাতে চাননি বলেই বাবার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি হয়নি এখনও। কাউকেই কখনও ঈর্ষা না করেও ঈর্ষণীয় হয়ে থেকেছেন। আফসোস ছাড়া প্রতিদিন বাঁচাই জেতা। জীবনটাকে সহজভাবে নেওয়ার মতো কঠিন কাজটা কতটা সাবলীলভাবে করা যায়, সেটা বাবাকে দেখে শেখার চেষ্টা করি। ঘোরানো-প্যাঁচানো ব্যাপারগুলো বাবা বুঝতে পারেন না বলেই হয়তো জীবন তার কাছে সবসময় সহজভাবে ধরা দিয়েছে।
তার আনন্দে আমাদেরকে আনন্দিত করে, তার ব্যথায় আমাদেরকে কষ্ট দেয়।
ভাইয়ের প্রতি, বোনের প্রতি কী অপরিসীম শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-স্নেহ কিংবা ভ্রাতৃত্ববোধে বন্ধন কতটা দৃঢ়, তাকে না দেখলে কখনও এতটা বুঝতে পারতাম না। এখনও এ বয়সেও ভাইয়ের জন্য, বোনের জন্য কাঁদেন। আমাদের কাছাকাছি তার বড় বোন থাকেন, আমাদের ফুফু থাকেন, মাঝে মাঝে সেখানে তিনি যান দেখতে, দুই ভাই-বোনের কী যে মমত্ববোধ, একটা পর্যায়ে তাদের অঝোর কান্না, চোখের পানি আমাদেরকে আপ্লুত করে। আমার ছোট ফুফুর ক্ষেত্রে একই কথা। ভাইয়ের জন্য, বোনের জন্য পাগলহারা তারা। একবার আমার বাবার কঠিন টাইফয়েড হয়েছিল, তাকে দেখার জন্য তিন বোন চলে গেলেন, তিন জায়গা থেকে। কয়েকবছর আগের কথা, আমাদের বড় চাচা-জ্যাঠা থাকতেন সিলেটে, আমরা সবাই সেখানে গিয়েছিলাম, ফিরে আসার সময় স্টেশনে ট্রেন ধরে দুই ভাই কাঁদছেন। আমেরিকা থেকে ভাইয়ের খোঁজ নিতে আমার আরেক চাচা প্রায় প্রতিদিন যোগাযোগ করে।
আমার শিশু বাবা, সহজ-সরল বাবাটা আজ অসুস্থ। অসুস্থতাকে তিনি কাবু করতে পারেন না, তাকে আক্রান্ত করে ফেলে। অসুস্থতাকে তিনি ভয় পান। কয়েকদিন আগের কথা, আমি হসপিটালে সেসময়, তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন, হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি হলেন, সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার পর অসুস্থ শরীরের মধ্যেও সোজাসুজি চলে এলেন আমার কাছে, হসপিটালে। আমাকে দেখার জন্য তার মনটা আনচান করছিল।
এই আমার বাবা। অসুস্থ বাবাকে দেখে মনে হয়, কতটা অসহায় আমি তাদের ছাড়া।
বাবার জন্য কিছুই করতে পারিনি, কিছু করতে পারছি না। এর চাইতে বড় কষ্ট আর কী আছে এ জীবনে! হয়তো এটা সব সন্তানের জন্য অপূর্ণতা।
লেখক : কলামিস্ট / সম্পাদনা : জব্বার হোসেন
