পানি নিয়ে ষড়যন্ত্র
বিশ্ব আজ পরিবেশ ও প্রতিবেশগত বিপন্নতার মুখে। বাংলাদেশের অবস্থা আরও ভয়াবহ। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প পরিকল্পনা নদীমাতৃক এদেশকে আরও ভয়াবহ বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিবে। ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি কি? প্রকল্পটি হচ্ছে, মোট ৩৭টি নদীকে ৩০টি সংযোগ খালের মাধ্যমে সংযুক্ত করা। হিমালয় অববাহিকার ১৪টি এবং উপদ্বীপ নদী হিসেবে পরিচিত ভারতের মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের ১৬টি নদীতে সংযোগ তৈরি। এই ৩০টি সংযোগ খালের দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ১২ হাজার কিলোমিটার। খালগুলোর গভীরতা হবে ৬ মিটার এবং প্রস্থে ৫০ থেকে ১০০ মিটার। ভারত সরকার মনে করছে এর মাধ্যমে ১৪০ মিলিয়ন হেক্টর (১ হেক্টর = ২৪৭ শতক অর্থাৎ প্রায় আড়াই একর) জমি সেচের আওতায় আসবে, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ৩৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন, সংযোগ খালের মাধ্যমে নৌ যোগাযোগ সম্প্রসারিত হবে। পক্ষান্তরে ভারতের পরিবেশবিদদের আশংকা হচ্ছে এতে সংযোগ খাল ও জলাধার নির্মাণের কারণে প্রায় ৫ লাখ লোক তাদের বর্তমান আবাসস্থল হারাবে। জলাধার নির্মাণের কারণে প্রায় এক লাখ বিশ হাজার হেক্টর বনভূমি এবং প্রায় সাড়ে তিন লাখ হেক্টরের বেশি জমি সম্পূর্ণ তলিয়ে যাবে। উচ্চমূল্য বিনিয়োগ করে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে জনসাধারণকে বিরাট অংকের করের বোঝা টানতে হবে। উচ্চমূল্য দিয়ে পানি কিনতে হবে।
সবচাইতে বড় আশংকার কথা হচ্ছে, সেচ এবং পানিয় জলের ব্যবস্থাপনা দেশি ও বিদেশি কোম্পানিগুলোর হাতে চলে যাবে। ভারত, নেপাল, ভূটান, মায়ানমার এবং চীনের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদী। এর মধ্যে ৫৪টি ভারত হয়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বয়ে যাওয়া এ সমস্ত নদীগুলোর মোট পানি প্রবাহের ৯৩ ভাগই আসে দেশের বাইরে থেকে। বাংলাদেশের প্রধান তিন নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা দিয়ে বছরে যে পানি প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে তার প্রায় ৬৭ ভাগ প্রবাহিত হয় ব্রহ্মপুত্র দিয়ে, ১৮ ভাগ প্রবাহিত হয় গঙ্গা-পদ্মা দিয়ে এবং ১৫ শতাংশ প্রবাহিত হয় মেঘনা দিয়ে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের মোট পানি প্রবাহের ৮৫ ভাগই আসে হিমালয়ের দুই নদী গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র দিয়ে। যে নদী বাংলাদেশের ভিত্তি তার উৎসভূমিই বাংলাদেশের বাইরে এবং এ নদীগুলোর ওপরই এদেশ নির্ভরশীল। এর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণও নেই। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি। বিপদাপন্নতার প্রধান কারণ।
যে নদী (পদ্মা) দিয়ে দেশের মোট পানি প্রবাহের ১৮ ভাগ প্রবাহিত হয় সে নদীর উজানে ভারতে গঙ্গায় নির্মিত ফারাক্কা বাঁধের কারণে দেশের পদ্মার অববাহিকা অঞ্চলের প্রায় ৩০ নদীর মৃত্যু ঘটেছে। গঙ্গা নির্ভরশীল অঞ্চলের এক প্রধান নদী গড়াই আজ মুমূর্ষু। ফারাক্কা বাঁধ তৈরির আগে গড়াই নদী দিয়ে বর্ষাকালে এক লাখ ৪২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৩ লাখ ২৮ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হতো। শুকনো মৌসুমেও গড়াইয়ের প্রবাহ ৯ হাজার কিউসেকের নিচে নামত না। অথচ ফারাক্কার কারণে এই গড়াই আজ মৃত্যুমুখে। ফারাক্কার কারণে অববাহিকা অঞ্চল বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ অসংখ্য নদী পানির অভাবে মৃত্যুদশায় উপনীত হয়েছে। দেখা দিয়েছে মারাত্মক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত সংকট।
ফারাক্কার অভিজ্ঞতা বলে, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে তা হবে বাংলাদেশের জন্য অস্তিত্ব বিনাশী। বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা নদী দুটোকে সংযোগ খাল কেটে সংযুক্ত করা হলে বাংলাদেশ তার পানি প্রবাহের প্রধান উৎসটি হারাবে। এর ফলে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং মধ্যাঞ্চলের নদীগুলো মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। শুরু হবে মরুকরণের প্রবনতা। নদীতে পানি প্রবাহ কমে গেলে সমুদ্রের লবনাক্ত পানি উপরে বহুদূর পর্যন্ত ওঠে আসবে। খরা মৌসুমে তীব্র পানি সংকট তৈরি হবে। এর ধারাবাহিক সুদূর প্রসারী প্রভাবে অবহমানকালের প্রকৃতি, পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ফসল উৎপাদন, বন ও মৎস সম্পদ সবকিছুই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পরিবেশবিদদের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশের বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে কমপক্ষে তিন হাজার কোটি টাকা। এ প্রকল্পের প্রতিক্রিয়ায় দেশে প্রতিবছর ২ লাখ লোক তাদের কর্মসংস্থান হারাবে, নতুন করে ৯ লাখ লোক দারিদ্র্যের শিকার হবে, খাদ্য উৎপাদন বছরে প্রায় এক লাখ টন করে কমে যেতে পারে। এক থেকে দেড় শতাংশ পর্যন্ত আভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) কমে যেতে পারে। গবেষকরা বাংলাদেশের আর যেসব ক্ষতির কথা বলেছেন সেগুলো হচ্ছে ১. নদী ব্যবস্থার ভারসাম্য বিনষ্ট হবে; ২. ভূমি গঠন প্রক্রিয়া বাঁধাগ্রস্ত হবে; ৩. প্রলয়ঙ্কারী বন্যার ঝুঁকি বাড়বে; ৪. সামুদ্রিক জোয়ারে আসা লবনাক্ততার অস্বাভাবিক বিস্তার ঘটবে; ৫. ভূমিকম্পের ঝুঁকি বহুগুন বেড়ে যাবে; ৬. জীব-বৈচিত্র হারিয়ে যাবে; ৭. জলবায়ু পরিবর্তনের গতি বৃদ্ধি পাবে। আর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিগুলো হচ্ছেÑ ১. ফসল উৎপাদন কমে যাবে; ২. সুপেয় পানির সংকট মারাত্মক রূপ নেবে; ৩. আর্সেনিক দূষণ বাড়বে; ৪. স্বাস্থ্য সমস্যা বৃদ্ধি পাবে; ৫. মরুকরণ প্রবনতা বেড়ে যাবে; ৬. বনাঞ্চল ধ্বংস হবে; ৭. মৎস্য সম্পদ ধ্বংস হবে এবং ৮. কোটি কোটি মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে।
আন্তর্জাতিক নদী সংযোগ প্রকল্পে প্রধান নদী ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা নদী এ প্রকল্পের আওতায়। গঙ্গা হিমালয়ের নেপাল অংশে জন্ম নিয়ে ভারতের ওপর দিয়ে বাংলাদেশে পদ্মা নামে প্রবাহিত হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের জন্ম হয়েছে তিব্বত অংশে। সেখান থেকে ভূটান এবং ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ফলে আন্তর্জাতিক নিয়মানুসারে কোনো আন্তর্জাতিক নদীর ক্ষেত্রে কোনো দেশ একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এ সংক্রান্ত জাতিসংঘের চার্টারে বলা আছে, ‘আন্তর্জাতিক নদীর পানি বন্টিত হবে অবশ্যই পারষ্পরিক সমঝোতা ও অঙ্গীকারের ভিত্তিতে। একটা দেশ কোনো অবস্থায়ই এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, যা অন্য দেশের পরিবেশে সমস্যা সৃষ্টি করে এবং কৃষি প্রকল্পকে বাঁধাগ্রস্ত করে।’ সুতরাং ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প আন্তর্জাতিক নদী ব্যবহার সংক্রান্ত হেলসিংকি (১৯৬৬) নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদের সু-স্পষ্ট লংঘন। শুধু তাই নয়, হেলসিংকি নীতিমালার ২৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘এক অববাহিকাভুক্ত একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক অববাহিকায় প্রবাহিত পানির ব্যবহার সম্পর্কে গৃহিত পদক্ষেপ গ্রহণ সম্পর্কে অবহিত করবে। শুধু তাই নয়, ১৯৯৬ সালে সম্পাদিত গঙ্গা চুক্তিরও লংঘন করছে ভারত। পানি চুক্তির ৯ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘উভয় সরকার অন্য নদীগুলোর ব্যাপারেও পানি বন্টন চুক্তি/সমঝোতায় পৌঁছাতে সম্মতিজ্ঞাপন করছে।’ ওই চুক্তিতে বন্টন নীতিমালা সম্পর্কেও বলা হয়েছিল ‘ন্যায্যতা, স্বচ্ছতা এবং কোনো পক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত না করা’। নদী সংযোগ প্রকল্প এ সমস্ত চুক্তিকে পুরোপুরিভাবে লংঘন করা হয়েছে। এতে শুধুমাত্র বাংলাদেশের মানুষই যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়, ভারতের জনগণও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাহলে প্রশ্ন আসে কেন এই প্রকল্প? এর উদ্দেশ্য ভিন্ন। আর সেটা হচ্ছে বাণিজ্যিক। বহুজাতিক কোম্পানিসমূহের মুনাফা লুটের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। যা দেশের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। তাই দরকার জোর কুটনৈতিক উদ্যোগ, যা রক্ষা করতে পারে আমাদের নদী ও পরিবেশ।
লেখক : সাংবাদিক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন