বিশেষজ্ঞরা বলছেন সচেতনতা জরুরি ভেজালেই চলছে পবিত্র রমজান
রিকু আমির : খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক ও ভেজাল নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-আতঙ্কের শেষ নেই। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, বেঁচে থাকার জন্য প্রধান মৌলিক চাহিদা যে খাদ্য সেই খাদ্য সামনে নিয়ে বসলে প্রথমেই প্রশ্ন জাগে ভেজাল-বিষাক্ত, রাসায়নিকমুক্ত খাবার খাচ্ছি তো? এরকম আতঙ্কের মধ্যেই চলছে পবিত্র রমজানে সাধারণ মানুষের খাওয়া-দাওয়া।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানাভাবে খাদ্যে ভেজাল বা বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রবেশ ঘটে। প্রাকৃতিকভাবে খাবার কিছুটা বিষাক্তবরণ হলেও বেশিরভাগই হয়ে থাকে অসচেতন কৃষক আর স্বার্থান্বেষী, অতি মুনাফালোভী, অসাধু ব্যবসায়ীর মাধ্যমে। এর মধ্যে কিছু বিষাক্ত রাসায়নিক কৃষিতে ব্যবহারের ফলে পানি, মাটি বা গাছ হয়ে খাদ্যশস্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে; আবার কিছু রাসায়নিক একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সরাসরি বিভিন্ন ফল, শাক-সবজি, মাছ-মাংস-দুধ, মসলাসহ নানা খাদ্যে ভেজাল, আকর্ষণীয় বা মুনাফাবর্ধক উপাদান হিসেবে প্রয়োগ করে থাকে।
প্রবীণ চিকিৎসক ও জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুল মালিক বলেন, মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও জীবন রক্ষায় দেশে এখন এক নম্বর ইস্যু হওয়া দরকার নিরাপদ খাদ্য। খাদ্য বিষযুক্ত হলে মানুষ বাঁচবে কী করে?
সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগারে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মহাখালী, গুলশান এলাকাসহ আরও বেশকিছু বড় বড় বাজার থেকে ৮২টি খাদ্যপণ্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছিল। এতে গড়ে ৪০ শতাংশ খাদ্যেই মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৩ থেকে ২০ গুণ বেশি বিষাক্ত উপাদান শনাক্ত হয়।
গবেষণার ফলাফল অনুসারে ৩৫ শতাংশ ফল ও ৫০ শতাংশ শাক-সবজির নমুনাতেই বিষাক্ত বিভিন্ন কীটনাশকের উপস্থিতি মিলেছে। এছাড়া আম ও মাছের ৬৬টি নমুনায় পাওয়া গেছে ফরমালিন। চালের ১৩টি নমুনায় মিলেছে মাত্রাতিরিক্ত বিষক্রিয়া সম্পন্ন আর্সেনিক, পাঁচটি নমুনায় পাওয়া গেছে ক্রোমিয়াম। হলুদের গুঁড়ার ৩০টি নমুনায় ছিল সীসা ও অন্যান্য ধাতু। লবণেও সহনীয় মাত্রার চেয়ে ২০-৫০ গুণ বেশি সীসা পাওয়া গেছে। মুরগির মাংস ও মাছে পাওয়া গেছে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর এন্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব। এছাড়া চারটি প্যাকেটজাত জুসের নমুনায় পাওয়া গেছে বেঞ্জয়িক এসিড, যা স্বাস্ব্যের জন্য ক্ষতিকর।
কেবল ইমপ্রুভিং ফুড সেফটি অব বাংলাদেশ প্রকল্পের মাধ্যমেই নয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে ২০১২ সালে ৫ হাজার ৩১২টি খাবারের নমুনা পরীক্ষা করে এর মধ্যে ২ হাজার ৫৫৮টিতেই বা ৪৯ শতাংশে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক বা ভেজাল উপাদান পাওয়া গেছে। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন গবেষণায়ও মাঝেমধ্যে বিভিন্ন খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়া যায়।
মৎস্য সম্পদ অধিদফতরের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মাছে ব্যবহƒত কীটনাশকের মধ্যে ৬০ শতাংশ চরম বিষাক্ত, ৩০ শতাংশ অপেক্ষাকৃত কম বিষাক্ত এবং মাত্র ১০ শতাংশ বিষাক্ত নয়। আর কৃষিজমিতে ব্যবহƒত কীটনাশকের প্রায় ২৫ শতাংশই জমিসংলগ্ন জলাশয়ের পানিতে মেশে। এছাড়া ওই কীটনাশক প্রয়োগের জন্য ব্যবহƒত যন্ত্রপাতি বা উপকরণ পরিষ্কার করতে গিয়ে আরও কিছু কীটনাশক পুকুর বা নালার পানিতে চলে যায়।
প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, রাষ্ট্র বা সরকার আইন করলেও মানুষ অনেক সময়ই তা মানে না। এ ক্ষেত্রে কেবল সরকারকে দুষলেই হবে না, মানুষের সচেতনতা খুবই জরুরি।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)Ñএর পরিচালক অধ্যাপক মাহামুদুর রহমান বলেন, খাদ্যজাত কৃষিতে কীটনাশকের ব্যাপক অপপ্রয়োগ এখন দেশের জনস্বাস্থ্যকে বিশাল ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। অন্তত কৃষিপণ্যকে কীটনাশক থেকে রক্ষা করা গেলে মানুষ অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত হতে পারে। সম্পাদনা : সৈয়দ নূর-ই-আলম