ভ্যাট জটিলতা থেকেই গেল
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
অনেক চেষ্টা করেও নতুন অর্থ বছরের শুরু থেকে ২০১২ সালের প্রণিত ভ্যাট আইনটি বাস্তবায়ন করা যায়নি। ব্যবসায়ীদের প্রতিরোধ যেমন তীব্র ছিল, তেমনি সরকারের দিক থেকে, বিশেষ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরেরও তেমন প্রস্তুতি ছিল না, বাস্তবায়নের আগ্রহ ছিল না।
তাই বলে রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়ায় যে ভ্যাটই চালিকা শক্তি হবে, সেই পথ থেকে সরকার পিছিয়ে আসেনি। অর্থ বিল ২০১৬, যেটি বাজেট পেশের দিন আনুমোদিত হয়েছে, সেখান থেকে বিষয়টি পরিষ্কার যে, ভ্যাট যারা দিচ্ছে তাদের আরও বেশি করে দিতে হবে। বিশেষ করে এনবিআরের এসেসম্যান্টের বিরুদ্ধে যারা আপিল করবেন তাদের জন্য দু:সংবাদই বেশি।
নতুন যে ব্যবস্থা আছে অর্থবিলে তাতে বলা হয়েছেÑ এনবিআরের এসেসম্যান্ট বা মাঠপর্যায়ের কোনো কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করতে গেলে ভ্যাটের যে পরিমাণ নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে তার ৫০ শতাংশ কিংবা জরিমানার অংশ আগে জমা দিতে হবে। বাকি ৫০ শতাংশ প্রয়োজন হবে আপিলাত ট্রাইব্যুনালে আবেদন জমা দিতে। রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের দাবিকৃত ভ্যাটে ভ্যাটদাতার আপত্তি থাকলে আপিল করার সুযোগ আইনেই রয়েছে। এতদিন দাবিকৃত ভ্যাটের ১০ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করে আপিল করা যেত। প্রস্তাবিত বাজেটে এটি চারগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হলো।
এই পুরো বিষয়টি মোটেও ব্যবসাসহায়ক নয় বলে বলছে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো। বিচার চাওয়া, প্রতিকার চাওয়া মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। সেই অধিকার এভাবে কেড়ে নেওয়া এক নেতিবাচক সংস্কৃতি। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়বে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, সুপার স্টোরগুলো যাদের ভ্যাট এসেসম্যান্ট সবসময়ই প্রশ্নবিদ্ধ থাকে। হয়রানি এড়াতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা যে পথ বেছে নেবে তাতে রাজস্ব কতটা সরকারের কোষাগারে যাবে, আর কতটা এনবিআরের মাঠপর্যায়ের কর্মীদের পকেটে যাবে তা দেখার বিষয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ফলে তাদের বাড়তি অর্থ গুনতে হবে। সেই সঙ্গে পরোক্ষভাবে ভ্যাট কর্মকর্তাদের কর্তৃত্ব কমানের বদলে তা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হলো। এখন থেকে ভ্যাট মূল্যায়নকালে তারা ইচ্ছেমত অর্থ নির্ধারণ করবেন। ফলে দুর্নীতি বিস্তারের সুযোগও বাড়ল।
এনবিআর কর্মকর্তারা বরছেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা আপিলের সুযোগ নিয়ে বছরের পর বছর সরকারকে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করে আসছেন। ট্রাইব্যুনালে আপিল করার ক্ষেত্রে মাত্র ১০ শতাংশ অর্থ পরিশোধের বিধান থাকায় তারা এনবিআর কর্মকর্তাদের যে কোনো সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে আপিল করতো। আপিলকালে তুলনামূলক কম অর্থ পরিশোধ করতে হতো বিধায় আইনের মধ্যে থেকেই তারা এ কাজটি করতে উৎসাহিত হতো। ফলে যথাসময়ে সরকারের ঘরে কাক্সিক্ষত রাজস্ব আসতো না।
এনবিআর, তথা সরকার এ পথে গিয়েছে যাতে করে মাঠপর্যায়ের কর্মীদের সিদ্ধান্তকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে না পারে। সরকার যে আগ্রাসী ভ্যাটনীতি নিয়েছে তার প্রমাণ আইনের এ নতুন বিধি। কিন্তু আইনি সহায়াতা চাওয়া, কিংবা বিচার চাওয়াকে ব্যয়বহুল করে তোলার মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় ক্ষতি হবে কিনা তা হয়তো ভাবা হয়নি। আগামী ২০১৭-১৮ অর্থ বছর থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকরের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে এই আইনি হয়রানি ব্যবসা-বাণিজ্যে নৈরাজ্য তৈরি করবে হয়তোবা।
সরকার হয়তো ভাবছে বিপুল পরিমাণ ঝুলন্ত মামলা এমনিতেই বড় আইনি সমস্যা তৈরি করছে। নতুন এ বিধির মাধ্যমে তাতে কিছুটা রাশ টেনে ধরা যাবে। তিন হাজারের অধিক মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় সরকার শত কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব আদায় করতে পারছে না। শুধু ভ্যাট সংক্রান্ত নয়, সরকার আয়কর সম্পর্কিত মামলার বেলায়ও এমন বেশি অর্থ আদায়ের বিধান রেখেছে অর্থবিলে। এনবিআরের হিসাবে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর মিলিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এ ধরনের বিরোধে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আটকে রয়েছে। এ সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা ১৫ হাজারের কাছাকাছি। প্রতি বছর সরকার এ অর্থ আদায়ে উদ্যোগ নিলেও এতে খুব একটা সুফল মিলছে না। অন্যদিকে মামলার সংখ্যা না কমে উল্টো বছর বছর বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে জট কমানোর স্বার্থে মামলায় নিরুৎসাহিত করতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এনবিআরের কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু এজন্য দরকার বিচার প্রক্রিয়া সহজ করা, ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন, নতুন করে পরিস্থিতি জটিল করা নিশ্চয় কাম্য নয়।
ব্যবসায়ীদের সমস্যা না দেখে প্রভাব খাটিয়ে, জোর করে অর্থ আদায় সত্যিকারের অর্থে কোন সৃজনশীল পদ্ধতি নয়। রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে, একথা সবাই বলবেন, এমনকি ব্যবসায়ীরাও নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেন না। কিন্তু যেকোনোভাবে, যেকোনো পদ্ধতি প্রয়োগ করে সেটা আদায় করা অগ্রহণযোগ্য।
পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি