নাজিমুদ্দিনদের বেলায় কিছুটা পিছুটানও ছিল
সত্তর সালে সে যখন ঢাকায় তখন এক সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে এসেছিল বন্ধুদের খোঁজে। সেখানে বসে চা খেতে খেতে আবিদ মন্তব্য করেছিল তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে, ‘আচ্ছা, পুরনো ঢাকায় এখন কারা থাকে’? আমি তার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকাতে জানিয়েছিল প্রশ্নের অন্তর্নিহিত কারণ। ছাত্রজীবনে ঢাকায় যখন ছিল তখন সে পুরনো ঢাকার দয়াগঞ্জে থাকত, কিন্তু এখন ফিরে এসে দেখছে পরিচিতজনরা সেখানে আর নেই, যাকেই জিজ্ঞাসা করে সেই বলে চলে এসেছে নতুন ঢাকায়। প্রশ্নটা তার ওই জন্যই, পুরাতন ঢাকায় তাহলে কারা থাকে। শহর যে উত্তর দিকে ছুটেছে ওই উপলব্ধিটা তো আমারও ছিল। সদরঘাট পিছিয়ে গেছে, উন্নতির প্রবাহ উত্তরমুখো, এয়ারপোর্টের দিকে। এয়ারপোর্ট হচ্ছে পশ্চিম জগতের সঙ্গে যোগাযোগের চিহ্ন। আবিদ নিজেও তো এক সময়ে তাই করেছিল, কিন্তু উনসত্তরে চলে এসেছে, ভেবে থাকবে, থাকতে যে পারবে না সেটা তো তার তখন জানার কথা নয়। এই উন্নতি যে পুঁজিবাদী ধারার, সেটা অবশ্য ততদিনে আমার নিজের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে; কিন্তু সেই সন্ধ্যায় সেটা তাকে বলা হয়নি, বলার কথাও নয়।
আবিদ ছিল বামপন্থার সমর্থক। সোহ্রাওয়ার্দীকে সে একদিন সলিমুল্লাহ হলের মাঠে সম্বর্ধনা জানাবার আয়োজন করেছিল তিনি যে উন্নতির পুঁজিবাদী ধারারই মস্ত কারিগর ছিলেন, সেটা তো সত্য। খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে সোহ্রাওয়ার্দীর একটা দ্বন্দ্ব ছিল। সেটা কেবল যে ব্যক্তিগত তা নয়, অবস্থানগতও বটে। নাজিমুদ্দিনরা ছিলেন পুরাতনপন্থি, তারা ব্রিটিশের ভক্ত। ব্রিটিশের প্রতি অনুরাগের ব্যাপারে সোহ্রাওয়ার্দীও যে পিছিয়ে ছিলেন তা অবশ্যই নয়। তারা দুজনেই ছিলেন ব্যারিস্টার, কিন্তু সোহ্রাওয়ার্দীর দৃষ্টি ছিল স্বচ্ছতর, তিনি এটা বুঝে নিয়েছিলেন যে, যুগ এসেছে আমেরিকার, এখন হাত ধরতে হবে আমেরিকারই। বয়সের হিসাবে সোহ্ারাওয়ার্দী বরং নাজিমুদ্দিনের তুলনায় দুবছরের বড়ই ছিলেন, কিন্তু নতুন যুগকে ধরবার ব্যাপারে ছিলেন এগিয়ে। যে জন্য তিনি আমেরিকার সঙ্গে সামরিক চুক্তিগুলোর একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন; নাজিমুদ্দিন মনে হয় অতটা পারতেন না। এরা দুজনেই পুঁজিবাদে বিশ্বাস করতেন, সেকালে রাজনৈতিক মূলধারার সব নায়কই সেটা করতেন, এখনকার নায়ক-নায়িকারা যে ভিন্নতর তা নয়, পুঁজিবাদে তাদের আস্থাটা এখন বরং আরও বেশি প্রকাশ্য। আর ওখানেই বোধ করি সে যুগে-এ যুগে একটা বড় ব্যবধান। সেকালে ব্যাপারটা আজকের মতো এতটা উন্মোচিত ছিল না। নাজিমুদ্দিনদের বেলায় কিছুটা পিছুটানও ছিল, যেটা তার পোশাকে ধরা পড়ত। নাজিমুদ্দিনরা শেরোয়ানি পরতেন, সোহ্রাওয়ার্দীরা থাকতেন স্যুটে শোভিত। তুলনায় সোহ্রাওয়ার্দীকেই বরঞ্চ খাঁটি বলতে হয়, ভেতরে বাইরে সমান সমান। কোনো লুকোছাপা ঢাকঢাক-গুড়গুড় নেই।
লেখক : অধ্যাপক ইমেরিটাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন