বাজেটে দাম বাড়া-কমা, ধনীর তুলনায় গরিবের খরচ বাড়ছে
হাসান আরিফ : সরকারের সম্পদ সংগ্রহের যেসব প্রস্তাব বাজেটে রয়েছে তা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রাজস্ব সংগ্রহের ৮০ ভাগই আসবে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত থেকে। ফলে দাম বাড়া-কমায় ধনীর তুলনায় গরিবের খরচ বাড়ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজেট সাধারণ মানুষ বুঝুক অথবা না বুঝুক এ নিয়ে এক ধরনের ভীতি সবসময় তাদের মধ্যে কাজ করে। মানুষের মধ্যে ধারণা তৈরিই হয়েছে বাজেট মানেই পণ্যমূল্য বাড়বে। তবে বাজেটে সব পণ্যের দাম বাড়ে এমন নয়। অনেক ধরনের পণ্য বা এর উপকরণের উপর শুল্ক বা কর যেমন বাড়ানো হয় তেমনিভাবে অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে কমানোও হয়। কিন্তু বাজেটের অঙ্ক যেভাবে চলতি মূল্যে প্রতি বছরই বেড়ে যায় তেমনিভাবে জিনিসপত্রের দামও একইভাবে বেড়ে যায়।
বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে শুল্কবিন্যাসে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তাতে কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানিতে নতুন করে শুল্ক আরোপ এ খাতের উৎপাদন খরচকে বাড়িয়ে দেবে। এতে চালের দাম যে এবারের বাজেটের পর আরেক দফা বাড়তে পারেÑ এটা দেশের দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের জন্য একটি দুঃসংবাদ। চাল আমদানির শুল্ক বাড়ানো হয়েছে ১৫ শতাংশ। স্থানীয় উৎপাদকদের মূল্য সমর্থনের যুক্তি দেখিয়ে এটি করা হলেও সার্বিকভাবে তা নেতিবাচক প্রভাবই ফেলবে।
চাল, ডাল বা কাপড় কাঁচার সাবানের উপর যদি কর আরোপ বা বাড়ানো হয় তাহলে তা ভিক্ষুকের উপরও তার প্রভাব পড়ে। একইভাবে প্রাইভেট গাড়ি এসি বা এ ধরনের বিলাসী পণ্যে কর আরোপ করা হলে তার প্রভাব পড়ে ধনীদের উপর। আবার বাসের মতো গণপরিবহন অথবা জনগণের নিত্যপণ্য পরিবহনের ট্রাকের উপর কর বাড়ানো হলে তার প্রভাব গরিব ও মধ্যবিত্তদের উপর বেশি পড়ে। যে ধরনের ভোক্তার ব্যবহারের পণ্যে কর আরোপ করা হবে তার চাপ পড়বে সে ধরনের ভোক্তার উপর।
বাজেটে আমদানি উৎপাদন বা ব্যবসায় সব পর্যায়ে আরোপিত রয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট। যে পর্যায়েই এটি আরোপিত থাক না কেন তা বহন করতে হয় যারা পণ্য বা সেবাটি ব্যবহার করছেন তাদের উপর। বাংলাদেশ সরকারের যে আয় হয় তার ৮৭ ভাগই হলো কর রাজস্ব। আর এই আয়ের দুই-তৃতীয়াংশ আসে পরোক্ষ কর থেকে।
এবারের রাজস্ব প্রস্তাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, নতুন অর্থবছরের জন্য যে ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তার মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অংশ হলো ২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করা হবে ভ্যাট থেকে। এ খাত থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৭৪ হাজার ২৫০ কোটি যা আগের বছরের মূল বাজেটের তুলনায় সাড়ে ১৫ শতাংশ বেশি। কিন্তু সংশোধিত বাজেটের তুলনায় বেশি ৩০ শতাংশের মতো।
জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত প্রস্তাবিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে কয়েকটি পণ্যের স্থানীয় পর্যায়ে ও আমদানিতে শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক ও রেগুলেটরি ডিউটি বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন। একইভাবে কিছু ক্ষেত্রে কমানোরও প্রস্তাব করা হয়েছে। কর বৃদ্ধির ফলে কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। একইভাবে কয়েকটি পণ্যের স্থানীয় পর্যায়ে ও আমদানিতে শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক ও রেগুলেটরি ডিউটি কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে শুল্ক কর কমানোর প্রেক্ষিতে কিছু পণ্যের দাম কমেছে।
যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে : বাজেটে তৈরি পণ্যের আমদানি ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সিগারেট, ওয়াশিং মেশিন, আমদানিকৃত চা।
চাল : চাল আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে। ফলে সুগন্ধিযুক্ত চালের দাম বেড়েছে। দেশীয় কৃষকদের সুরক্ষায় এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
গম ও ভুট্টা : ভুট্টার আটার উপর ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে গম ও ভুট্টার উপর ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে ভুট্টা ও গমজাতীয় পণ্যের দাম বেড়েছে।
ওষুধ : ওষুধ শিল্পের কাঁচামালের উপর আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করায় ওষুধের দাম বেড়েছে।
বই : বই আমদানিতে শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে। এছাড়া দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক আমদানিতে শুল্ক ১০ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এ কারণে বইয়ের দাম বেড়েছে।
রাসায়নিক পণ্য : টেলকম পাউডার, ইসিজি ও আল্ট্রাসাউন্ড পেপার, পাল্পের তৈরি ফিন্টার ব্লকস-এর শুল্ক বাড়ানোর কারণে এসব রাসায়নিক পণ্যের দাম বেড়েছে।
মোবাইল বিল : মোবাইল ফোনের সিম ব্যবহার করে কথা বলাসহ অন্যান্য সেবার উপর সম্পূরক শুল্ক ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে মোবাইল ফোনের সিমভিত্তিক সব ধরনের সেবার উপর গ্রাহকের খরচ বেড়েছে।
সুগন্ধি : সুগন্ধির উপর ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করায় সুগন্ধির দাম বেড়েছে।
সিগারেট : এবারের বাজেটে সিগারেটের মূল্যস্তর ও সম্পূরক শুল্ক হার বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করা হছে। এছাড়া সিগারেট পেপার ও উৎপাদনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে সিগারেটের দাম বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে সস্তা দামের সিগারেটে। কারণ নিম্ন স্তরের সিগারেটের মূল্যস্তর ও সম্পূরক শুল্ক সবচে বেশি বাড়ানো হয়েছে।
ওয়াশিং মেশিন : এ পণ্যটির আমদানি শুল্ক ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তাই বাজেটের পর পণ্যটির দাম বেড়েছে।
ট্রাভেল ব্যাগ : বিগত দিনে ট্রলি ব্যাগ, সুটকেস, ট্রাভেল ব্যাগ আমদানিতে সুনির্দিষ্ট এইচএস কোড ছিল না। এর ফলে এসব পণ্য আমদানি আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এসব পণ্যের এইচএস কোড (৮৩.০২) নির্ধারণ করে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম বেড়েছে।
চা : আমদানিকৃত চায়ের দাম বেড়েছে। কারণ বাজেটে প্রতি কেজি আমদানিকৃত চায়ের ট্যারিফ মূল্য দুই ডলার নির্ধারণ করে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে আমদানি করা চায়ের দাম বেড়ে গেছে। যদিও চা উৎপাদনে দেশ স্বয়ং সম্পূর্ণ। তাই দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অপটিক ক্যাবল : দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার স্বার্থে ফাইবার অপটিক ক্যাবল আমদানির শুল্ক ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে পণ্যটির দাম বেড়েছে।
মশার ব্যাট : মশা ও পোকামাকড় নিধনের কাজে ব্যবহৃত ব্যাট আমদানিতে এইচএস কোড সৃষ্টি করে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এ কারণে পণ্যটির দাম বেড়েছে।
দাম কমবে যেসব পণ্যের : আমদানি পণ্যের শুল্ক হ্রাসের প্রস্তাবের ফলে কয়েকটি পণ্যের দাম কমবে। এর মধ্যে হাইব্রিড গাড়ি, মোটরসাইকেল, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র অন্যতম।
হাইব্রিড গাড়ি : বাজেটে হাইব্রিড গাড়ি আমদানির অনুমতি পাচ্ছে পুরাতন গাড়ি আমদানিকারকরা। এর সঙ্গে হাইব্রিড গাড়ির সিসি ক্যামেরা ও সম্পূরক শুল্কহার পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে। ফলে হাইব্রিড গাড়ির দাম কমেছে।
মোটরসাইকেল : আমদানি করা সংযোজিত (সিকেডি) মোটরসাইকেলের সম্পূরক শুল্ক ৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। এ কারণে মোটরসাইকেলের দাম কমেছে।
সিমেন্ট : সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল ফ্লাইএশের শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে সিমেন্টের দাম কমেছে।
পাথর : নির্মাণ খাতকে সহায়তা দিতে বাজেটে বোল্ডার পাথর ও ভাঙা পাথর আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। এতে পাথরের দাম কমেছে।
ওয়াইফাই : সার্ভার র্যাক আমদানি শুল্ক ১০ থেকে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া ওয়াইফাই, ওয়াইম্যাক্স, একসেস পয়েন্ট এবং ফায়ারওয়াল (সিকিউরিটি হার্ডওয়ার) আমদানির শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ কারণে এসব পণ্যের দাম কমেছে।
পেট্রোলিয়াম জেলি : শীতকালে ত্বকের সুরক্ষায় ব্যবহৃত পেট্রোলিয়াম জেলির দাম কমেছে। কারণ পেট্রোলিয়াম জেলি তৈরি কাঁচামাল হোয়াইট পেট্রোলিয়ামের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
কয়লা : এনথ্রাসাইট ও বিটুমিনাস কয়লা দেশীয় অবকাঠামো নির্মাণের ভূমিকা রাখছে। তাই বাজেটে এ দুই প্রকারের কয়লার আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ করা হয়েছে।
অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র : অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। তাই আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহৃত পণ্যের দাম কমেছে।
খেলনা : বিভিন্ন শর্তে খেলনা শিল্পের যন্ত্রপাতি ও উপকরণ আমদানিতে শুল্ক হ্রাসের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে এসব পণ্যের দাম কমেছে।
আরও যেসব পণ্য ও সেবার দাম কমেছে : পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের সব ধরনের তৈরি পোশাক, অন্তর্বাস, দেশলাই, ট্র্যাক স্যুট ও সমজাতীয় পণ্য, কৃত্রিম ফুল, ফল, কাস্ট অথবা রোল গ্লাস, ড্রন গ্লাস ও বোন গ্লাস শিট, খেলার তাস, ডাম্পার ট্রাক, কোকাযুক্ত চকলেট ও অন্যান্য খাদ্য প্রিপারেশন, কোকাযুক্ত নয় এমন সুগার কনফেকশনারি (সাদা চকলেটসহ), তৈরি চকলেট, জ্যাম-জেলি, মারমালেডস, ফল বা বাদামযুক্ত পিউরি, ফল বা বাদামের পেস্ট, গ্রিজ (খনিজ), প্লাস্টিকের তৈরি দরজা, জানালা, বাক্স, কেইস, টেবিলওয়্যার বা কিচেনওয়্যার, সেলফ এডহেসিভ প্লেট, শিট, ফিল্ম, ফয়েল, টেপ, স্ট্রিপ, কার্বয়, বোতল, ফ্লাস্ক ও প্যালেটস, সব ধরনের পার্টিক্যাল বোর্ড, ওরিয়েন্টেড স্ট্রান্ড বোর্ড, ফাইবার বোর্ড, হার্ড বোর্ড, প্লাইউড, ভিনিয়ার্ড প্যানেলস্ ও সমজাতীয় লেমিনেটেড পণ্য, দরজা, জানালা, প্যারকিট প্যানেল ও শাটারিং, পেপার ও পেপার বোর্ড, কার্টন, বক্স, কেস, করোগেটেড পেপার ও পেপার বোর্ড, স্ন্যাকস্ ও ব্যাগস্, মুদ্রিত বই, ব্রশিউর ও লিফলেট, ছাপানো ছবি ও ফটোগ্রাফসহ অন্যান্য ছাপানো পণ্যসামগ্রী, মিষ্টি বিস্কুট, ওয়াফলস ওয়েফার, পশুখাদ্যের পুষ্টি প্রিমিক্স, হিমাগার সেবার বিদ্যুৎ বিল, পলিয়েস্টার সুতার কাঁচামাল পেটচিপস, আয়রন অক্সাইড, প্লাস্টিক দানা, বাসবার ট্রাংকিং সিস্টেম ও ফ্লাক্স ফাইবার প্রভৃতি।
সম্পাদনা : সৈয়দ নূর-ই-আলম