৬ জনের মধ্যে একজন নিহত, আরেকজন পুলিশ হেফাজতে বাকি ৪ জঙ্গি ধরার চেষ্টায় পুলিশ
আজাদ হোসেন সুমন ও মাসুদ আলম : ব্লগার, প্রগতিশীল লেখক ও প্রকাশক হত্যায় জড়িত ৬ জনকে চিহ্নিত করে তাদের ধরিয়ে দিতে ১৮ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এরা প্রত্যেকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সক্রিয় সদস্য। এই ৬ জনের মধ্যে শরিফুল ওরফে সাকিব ওরফে শরিফ ওরফে সালেহ ওরফে আরিফ ওরফে হাদী-১ এবং সেলিম ওরফে ইকবাল ওরফে মামুন ওরফে হাদী-২ এর জন্য ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। বাকি ৪ জনের প্রত্যেকের জন্য দুই লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল গত মে মাসে।
৪ জন হলেনÑ সিফাত ওরফে সামির ওরফে ইমরান, আব্দুস সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে সালমান ওরফে সাদ, শিহাব ওরফে সুমন ওরফে সাইফুল ও সাজ্জাদ ওরফে সজিব ওরফে সিয়াম ওরফে শামস। এদের মধ্যে শনিবার রাত ৩টায় রাজধানীর রামপুরায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান শরিফ ওরফে হাদী-১। তার বাড়ি সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ধুলিহড় ইউনিয়নের বালুইগাছা গ্রামে।
পত্রিকায় ছবি দেখে গতকাল সোমবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে নিহতের দুলাভাই হেদায়েতুল ইসলাম ও তার চাচাতো ভাই লাশ শনাক্ত করেন। এ প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের জবাবে হেদায়েতুল বলেন, শরিফ নয়, তার আসল নাম মুকুল রানা। তার বাবার নাম আবুল কালাম আজাদ।
শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুলের উপর হামলার ঘটনায় পুরস্কারের প্রথম জঙ্গিকে বুধবার রাতে রাজধানীর বিমানবন্দর থানার ওভারব্রিজের পাশে বাসস্ট্যান্ড থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তার নাম মো. সুমন হোসেন ওরফে শাকিব ওরফে শিহাব ওরফে সাইফুল সুমন। সুমনের বাড়ি চাঁদপুরে হলেও সে বড় হয়েছে চট্টগ্রামের হালিশহরে। বর্তমানে হালিশহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে সুমনের পরিবার। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান সে। তার বাবা পেশায় গাড়িচালক। স্বল্প বেতনে চাকরি করত সুমন। সুমনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে শনিবার রাতে রামপুরা বনশ্রী এলাকার জে ব্লকে অভিযান চালায় পুলিশ।
রামপুরায় অভিযান চলাকালে একটি মোটরসাইকেলে তিনজন দ্রুতগতিতে ডিবির চেকপোস্ট অতিক্রম করার সময় তাদের থামতে বলা হয়। কিন্তু তারা পালানোর চেষ্টা করেন এবং ডিবিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। পরে ডিবিও পাল্টা গুলি চালালে মোটরসাইকেলসহ তিন আরোহী রাস্তায় পড়ে যান। দুজন দৌড়ে পালিয়ে গেলেও শরিফ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
নিহত মুকুল রানার দুলাভাই হেদায়েতুল ইসলামের সঙ্গে গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে কথা হয়। তিনি বলেন, স্কুল-কলেজের সনদে তার শ্যালকের নাম মুকুল রানা। স্থানীয় লোকজনও তাকে মুকুল রানা নামে চেনেন। তার বয়স ২৩ বছর। তিনি সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ইংরেজি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। দুই বছর ধরে পড়াশোনা বাদ দিয়েছেন। মুকুলের বাবার দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন। সেই পক্ষে মাসুদ রানা নামের এক ছেলে আছে। তিনি চিংড়ি ঘেরে কাজ করেন। দ্বিতীয় ঘরে মুকুলের জন্ম। তার এক বোন, নাম শারমীন সুলতানা রিমি। রিমি সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজের স্নাতক শ্রেণিতে ইসলামের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
তিনি আরও বলেন, মুকুলের বাবা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ঢাকায় অন্য কোনো দলের সঙ্গে তার ছেলে জড়িয়ে পড়েছিল কি না, তা তিনি জানেন না। মুকুল খুব মেধাবী ছিলেন। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় তিনি জিপিএ-৫ পান। মুকুল রানা চার মাস ধরে নিখোঁজ ছিলেন। তিনি চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি যশোরের জগন্নাথপুরে বিয়ে করেছেন। তার স্ত্রীর নাম মৌহা আক্তার রিমি। বিয়ের পর একবার সাতক্ষীরায় বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি। এরপর আবার যশোরে শ্বশুরবাড়িতে যান। ২৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় যশোরের বসুন্দিয়া এলাকা থেকে তাকে কে বা কারা তুলে নিয়ে যায়। এ ঘটনার ৩-৪ দিন পর যশোর কোতোয়ালি থানায় মুকুল রানার শ্যালক আমির হোসেন একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এক বছর আগে চাকরির সন্ধানে ঢাকায় আসেন মুকুল রানা। থাকতেন উত্তরায়। তবে উত্তরায় কী করতেন তা জানা নেই তাদের।
জানা গেছে, গত কয়েক বছরে সংঘটিত ব্লগার, প্রগতিশীল লেখক, প্রকাশক হত্যাকা-ের ঘটনাগুলো ‘অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে’ তদন্ত করে আসছিল ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। তদন্তের ধারাবাহিকতায় গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বাড্ডার সাঁতারকুল ও মোহাম্মদপুরে দুটি ‘জঙ্গি আস্তানায়’ অভিযান চালিয়ে গোয়েন্দা বিভাগ জানতে পারে, আস্তানা দুটি আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) ‘সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ ও ‘বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। ওই অভিযানে গ্রেফতার আনসারুল্লাহর দুই সদস্যের দেওয়া তথ্য ও সেখান থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন নথির ভিত্তিতে ঢাকার আশকোনা ও দক্ষিণখানে তাদের আরও দুটি আস্তানার সন্ধান পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে এবিটির ৬ জনের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মেলে।
পুলিশ বলছে, ওই ৬ জন গতবছর ঢাকায় লেখক অভিজিৎ রায় থেকে শুরু করে সর্বশেষ কলাবাগানে সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়ের মতো বিভিন্ন হত্যাকা-ে জড়িত। এর পর ওই ৬ জনের ছবি প্রকাশ করে পুলিশ। তবে পুরস্কার ঘোষিত চার জঙ্গি এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের ধরতে অভিযান চলছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ জানান, অভিজিৎ রায় হত্যার পুরো প্রক্রিয়াটি সমন্বয় করেছিল বন্দুকযুদ্ধে নিহত শরিফ। বইমেলায় অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যার দিন তার গতিবিধির উপর নজর রাখছিল শরিফ। অভিজিৎ কোথায় যাচ্ছে, কোন পথ দিয়ে বই মেলায় এসেছে, কোন পথ দিয়ে বের হয়, তা সে মোবাইল ফোনে এসএমএস দিয়ে তার সংগঠনের সদস্যদের জানিয়েছিল। গ্রেফতারকৃত জঙ্গিদের কাছ থেকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, পলাতক বাকি চারজনকে ধরতে অভিযান চলছে। তারা বার বার অবস্থান পরিবর্তন করেছে। অতিদ্রুত তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে। কারণ তারা সীমান্ত পার হতে পারেনি, দেশের ভেতরেই আছে।
সম্পাদনা : হাসিবুল ফারুক চৌধুরী