
ছেলের পাঠের অপেক্ষায় বাবার চিঠি
র্যাচেল এল সর্নস : হার্লেমের কালো সংস্কৃতির গবেষণা প্রতিষ্ঠান শমবার্গ। পুরো নাম শমবার্গ সেন্টার ফর রিসার্চ ইন ব্লাক কালচার। এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের দোতলায় বাক্সের স্তূপ। আর্কাইভ কর্মীরা বাক্স ভর্তি নথিপত্র নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। বাক্স ভরা হলুদ কাগজের চিঠিগুলোর তারিখ ৫০ বছর আগের। এই চিঠিপত্র এক কেনীয় তরুণের জীবন-সংগ্রাম ও স্বপ্ন দিয়ে ভরা।
বাইশ বছরের এই তরুণ উচ্চাকাক্সক্ষী, কর্মঠ। তিনি কেরানির কাজ করেন, মিনিটে ৭৫ শব্দ টাইপ করতে পারেন এবং ইংরেজি থেকে সোয়াহিলি ভাষায় অনুবাদ করতে পারেন। তবে কলেজে লেখাপড়া করার সঙ্গতি ছিল না তার। যে কারণে নাইরোবির টাইপিং ছেড়ে দিয়ে আটলান্টিকের ওপারের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও ফাউন্ডেশনে আর্থিক সহায়তার জন্য আবেদন করতে থাকে। এই তরুণের নাম বারাক হুসেইন ওবামা। ১৯৫৮ সালে তিনি লিখেছেন, আমার দীর্ঘদিনের ইচ্ছে ছিল আমেরিকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা। তার এই চিঠি লেখা চলছিল স্কলারশিপ পেয়ে আমেরিকা পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত। আমেরিকায় তিনি এক ছেলের জনক হন। ছেলে জন্মের কয়েক বছর পরই তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ওই ছেলেই পরে আমেরিকার প্রথম কালো মানুষ হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
শমবার্গ সেন্টার ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে তাদের খুঁজে পাওয়া নথিপত্র দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এর মধ্যে তার বাবার লেখা অন্তত ২৪টি চিঠি আছে। আর আছে হাওয়াই ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নম্বরপত্র, সমর্থক, উপদেষ্টা ও অধ্যাপকদের সনদ। তিন বছর পর বারাক ওবামা যখন হোয়াইট হাউসে বাবা-দিবস উদযাপন করছেন তখন পর্যন্ত হোয়াইট হাউসের উত্তরের অপেক্ষা করছে শমবার্গ সেন্টার। এখানকার দলিলপত্রের মূল্যবান সম্ভার সম্প্রতি জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়। এসব থেকে বারাক ওবামা সিনিয়র-এর একটি চরিত্র-বৈশিষ্ট দৃশ্যমান হয় তার নিজের লেখা থেকেই। এগুলোর মধ্যে কিছু তার নিজের হাতে লেখা। এতে তিনি বর্ণনা করেছেন আমেরিকায় তার লেখাপড়ার কথা। এতে আছে পিতা-পুত্রের বিচ্ছেদের করুণ কাহিনীও।
হোয়াইট হাউসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আগামী বছর দায়িত্ব শেষ হলে প্রেসিডেন্ট ওবামা এই দলিলপত্র দেখতে যেতে পারেন। তবে কি কারণে শমবার্গ সেন্টারের চিঠির জবাব দেওয়া হয়নি বা এ বিষয়ে কেন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন এই কর্মকর্তা। (শনিবার এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত প্রেসিডেন্টকে এ বিষয়ে জানানো হয়নি বলে জানান এ কর্মকর্তা)। শমবার্গ সেন্টারের পরিচালক খলিল জিবরান মুহাম্মদ জানান, দলিলপত্রগুলো সমৃদ্ধ, ভালো লাগার মতো, ঐতিহ্যপূর্ণ, একজন নিজস্ব চেষ্টায় বেড়ে ওঠা মানুষের গল্প। তিনি আশা প্রকাশ করেন, কোনো একদিন প্রেসিডেন্ট ওবামা এগুলো পড়বেন। কেননা, নিজের শেকড় সম্পর্কে জানার বিষয়ে অনেক কারণ নিহিত থাকে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, বার বার বলেছেন যে, তার বাবা জীবন থেকে তাকে পরিত্যাগ করেছিলেন। ১৯৬৪ সালে বারাক ওবামা সিনিয়র কেনিয়ায় ফিরে যান। তখন প্রেসিডেন্ট ওবামা মাত্র তিন বছরের শিশু। ওবামা যখন দশ বছরের, তখন মাসে একবার দেখা হতো তার বাবার সঙ্গে। নিউইয়র্ক টাইমস-এর সঙ্গে গত মাসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেন, তার বাবার চলে যাওয়া তাকে কিশোর বয়সেই জীবন সংগ্রামে ঠেলে দেয়। তাকে বুঝতে শেখায় জীবনের মানে কী।
প্রেসিডেন্ট ওবামা তার বাবার বেদনা বোধকে অনুধাবন করেন এবং তার বাবার স্মৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতর হন। বলেন তার বাবার কাছ থেকে পাওয়া স্বপ্নের কথা। তিনি উল্লেখ করেন, সেই ব্যক্তিটি সম্পর্কে তার জানার আকুলতার কথা, যিনি তাকে নাম দিয়েছেন। ২০ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট ওবামা একবার কেনিয়ায় যান। সেখানে তার অনেক প্রশ্নে উত্তর খুঁজে পান তিনি। তবে সব ধাঁধার কিনারা হয়নি। প্রেসিডেন্ট ওবামা উল্লেখ করেন, তার বাবার উচ্চাকাক্সক্ষাকে কোন উদ্দীপনা উস্কে দিয়েছিল, তা এখনও তার কাছে অজানা।
বারাক ওবামা সিনিয়রের চিঠিগুলো ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যে লেখা। এ সময় তিনি আমেরিকায় অবস্থান করছিলেন। চিঠিগুলো তার এ সময়ের নতুন দিক উন্মোচন করবে। এই দলিলগুলো রাখা আছে ওই সময়ে একটি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আমেরিকান ছাত্রদের দেওয়া বৃত্তির দলিলপত্রের সঙ্গে। এসব কাগজপত্র পুরনো দুঃখকেও জাগিয়ে তুলতে পারে।
বারাক ওবামা সিনিয়র তখন হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকের ছাত্র। ১৯৬০ সালের কথা। ওবামা সিনিয়র ঘনিষ্ঠ হন তার সহপাঠি এ্যান ডানহামের সঙ্গে। কেনিয়ায় তখন তার স্ত্রী এবং দুই সন্তান আছে। পরের বছর এ্যানকে বিয়ে করেন ওবামা সিনিয়র। ১৯৬১ সালের ৪ আগস্ট তাদের ছেলে জন্ম নেয়। কিন্তু ওবামা সিনিয়র তার নতুর স্ত্রী-সন্তান সম্পর্কে কাউকে কিছু বলেননি। এমনকি তার স্কলারশিপের দরখাস্তেও তিনি তাদের কথা উল্লেখ করেননি। ১৯৬৩ সালে ওবামা সিনিয়র হার্ভার্ডে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়ায় আর্থিক সহায়তার জন্য আবেদন করেন। আবেদনপত্রের একটি ঘর ছিল তার বৈবাহিক অবস্থা এবং নির্ভরশীলদের সংখ্যা উল্লেখ করার জন্য। তিনি এই ঘরটি ফাঁকা রাখেন।
বারাক ওবামা সিনিয়রকে তার আত্মীয়স্বজন জটিল মানুষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তারা বলেন, তিনি ছিলেন মেধাবী, স্বেচ্ছাচারী, আকর্ষণীয় ও দুর্বিনীত। তিনি এ সময় প্রচুর মদ পান করতেন। তখন তিনি কেনিয়া সরকারের একজন শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। ৪৬ বছর বয়সে স্বপ্ন পূরণের আগেই তিনি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান।
গত মাসে কেনিয়া থেকে টেলিফোনে একটি সাক্ষাৎকার দেন প্রেসিডেন্ট ওবামার কেনিয়াবাসী ভাইদের মধ্যে ছোট জন। এতে তিনি আশা করেন, দলিলপত্রগুলো তার পরিবারের সব ভাইবোন পরস্পরের সম্পর্কে পূর্ণভাবে জানতে সহায়ক হবে। প্রেসিডেন্ট ওবামার এই ভাই বলেন, তাদের বাবা আমেরিকায় ফেলে আসা তার ভাইয়ের লালন-পালনে কার্পণ্য করেননি। তিনি তরুণ বারাক ওবামার ছবি ও স্কুলের প্রগ্রেস রিপোর্ট দেখান গর্বভরে। এই তরুণই এখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্ট ওবামা তার জীবনকে একটি আমেরিকান গল্প বলে উল্লেখ করেন। কানসাসের এক সাদা তরুণী আর কেনীয় কালো পূরুষের এক ছেলে অভাবনীয়ভাবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়ে যাওয়ার গল্প এটি। তার বাবার গল্পও স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতোই। তার সফর শুরু হয়েছিল এক ধুলিময় গ্রাম থেকে, এসে ঠেকেছিল হার্ভার্ডের ছাত্রাবাসে। ইন্টারন্যাশনাল নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনুবাদ করেছেন মহসীন আব্বাস
