অপরিকল্পিত গ্রাম ও আবাসনের ফলে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে
এ কে এম এ হামিদ
এদেশের তিন চতুর্থাংশ মানুষ সরাসরি কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত। এ তিন চতুর্থাংশে মানুষের জীবনজীবিকা চলে কৃষি উৎপাদন ও কৃষিবিপণন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আবসনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও জমির চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ফলে কৃষি জমির ওপর চাপ ক্রমবর্ধমান। পরিকল্পিত অর্থনীতি ব্যতীত এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর সার্বিককল্যাণ বয়ে আনা সম্ভব নয়। সীমিত আয়তনের এই দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে অন্যান্য সেক্টরের প্রসারে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
বাণিজ্যিক বিবেচনায় কৃষি জমির মাত্রারিক্ত ব্যবহারের কারণে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার ৯৬ বিঘা বা ৬৯২ একর কৃষিজমি হ্রাস পেয়েছে। এসকল জমির বেশিরভাগই অকৃষিখাতে ব্যবহৃত হয়েছে। পাশাপাশি জলাশয় ভরাটের মাধ্যমে প্রতিদিন কৃষিজমি কমছে ৯৬ বিঘা। পরিস্যংখান থেকে জানা যায়, ২০০৩ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত মোট ২৬ লাখ ৫৫ হাজার ৭৩১ একর কৃষিজমি অকৃষিখাতে চলে গেছে। এই হিসেবে বছরে এ রূপান্তরের পরিমাণ ৭ লাখ ৩০ হাজার ৩২৬ বিঘা জমি। প্রতিদিন কমছে, দুই হাজার বিঘা কৃষিজমি।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘এ্যাসেনসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মোট ভূমির পরিমাণ প্রায় ১৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন হেক্টর।
এর মধ্যে প্রায় ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ জুড়ে রয়েছে বনভূমি। ২০ দশমিক ১ শতাংশের স্থায়ী জলাধরা, ঘরবাড়ি, শিল্প-কারখানা, রাস্তাঘাট ইত্যাদি। অবশিষ্ট ৬৬ দশমিক ৬ শতাংশ জমি কৃষি কাজের জন্য ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশে কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৭৬ লাখ ৮৪০টি। তাদের প্রায় ৬০ ভাগই প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক। কৃষিজমি অকৃষিতে রূপান্তরিত হওয়ায় এ প্রান্তিক কৃষকদের অবস্থা দিনদিন খারাপের দিকে যাচ্ছে।
ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে কৃষিজমি রক্ষা করাটা অতীব জরুরি। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বছরে ২৫ লাখ মানুষ বাড়ছে। এই বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্যনিরাপত্তা ও আবাসনের বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশে ভূমি ব্যবহারের জন্য নীতিমালা হওয়া উচিত।
দেশে ভূমি ব্যবহারের সমন্বিত পরিকল্পনা নেই। তাই রাষ্ট্র জমির পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারছে না বা ব্যর্থ হচ্ছে। এ জন্য দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। যে হারে কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে, তার মধ্য দিয়ে জাতি চরম সঙ্কটের দিকে এগিয়ে চলছে। ভবিষ্যতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা। তাই আর বসে থাকার সময় নেই।
দেশের সবরকমের জমি ব্যবহার এখনই সমন্বিত পরিকল্পনা বা নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। দেশে রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজ, হাসপাতালসহ বিভিন্নরকম স্থাপনা অনেকটা অপরিকল্পিতভাবেই করা হচ্ছে। এর ফলে প্রচুর পরিমাণ জমি নষ্ট হচ্ছে। গ্রামীণ কৃষিজমি রক্ষায় বিচ্ছিন্নভাবে বাড়ি নির্মাণ না করে গ্রামগুলোকে ছোট ছোট শহরে পরিণত করার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।
দেশে জনসংখ্যার বিষয়টি মাথায় রেখে কৃষিজমি রক্ষার পরিকল্পনামাফিক জনবসতির জন্য আবাসন প্রকল্প নির্মাণ নীতিমালা ও বাস্তবায়ন করা অতীব জরুরি। দেশের ৮০ লক্ষ হেক্টর কৃষিজমির মধ্যে প্রতিবছর প্রায় ১ লক্ষ হেক্টর জমি বাড়িঘর ইত্যাদির জন্য হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমান হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ২০৫০ সালে দেশে জনসংখ্যা হবে ২৩ কোটি। তখন কৃষিজমি গাণিতিক হারে হ্রাস পাবে। সুদূরপ্রসারি দৃষ্টিতে কল্পনা করলে অনুবাধন করা যাবে, তখন সমগ্র দেশই শুধু ঘর বাড়িতে পরিপূর্ণ। কৃষির জন্য কোনো জমিই অবশিষ্ট নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিশাল জনগোষ্ঠীর খাবার উৎপাদিত হবে কোথায়?
তাই বর্তমান ধাঁচের চলমান কার্যক্রম জরুরিভাবে বন্ধ করে কৃষিজমি রক্ষায় জাতীয়ভাবে সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে এ বিষয়ে সচেতনতা লক্ষণীয়। ৪/৫ তলা ভবন নির্মাণের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আবাসন সমস্যা মিটাবার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়।
যদি ৪/৫ তলা ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় তাহলে তা হবে বড় ভুল। যারা সরকারকে এ পরামর্শ প্রদান করছেন, তারা সঠিক কাজটি করছেন না বলে মনে করি। কেননা, অল্প কয়েকবছর পরেই ওইসব ভবন ভেঙে ফেলে ১৫/২০ তলা বিল্ডিং নির্মাণ করতে হবে। অগত্যা যদি বর্তমানে অর্থসঙ্কটের কারণে ৪/৫ তলা করতে হয়, সেক্ষেত্রে ১৫/২০ তলা বিল্ডিং এর ফাউন্ডেশন রাখা উচিত হবে।
লেখক : সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি) ও কো-চেয়ারম্যান, সার্ক ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ফোরাম (এসডিইএফ)
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন