তিন দশকেও হলো না নতুন ও শুদ্ধনীতি
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
মানসম্মত ওষুধ উৎপাদনে ব্যর্থ ২০ ওষুধ কোম্পানির সকল ধরনের উৎপাদন বন্ধে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ১৪টি ওষুধ কোম্পানির অ্যান্টিবায়েটিক উৎপাদন বন্ধেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ৭ জুন হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেয়।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আসে ওষুধ শিল্প থেকে? এছাড়া ওষুধের অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় ৯৭ ভাগ যোগান দেয় এই শিল্প। বাংলাদেশের অগ্রগতির নিদর্শন বলে বিবেচিত হতে পারে ওষুধ শিল্প। স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশ ওষুধের ক্ষেত্রে ছিল বিদেশ নির্ভর। আর এখন প্রায় শতভাগ স্বনির্ভর। তবে মানহীন ওষুধ উৎপাদনের জন্য ২০ কোম্পানির বিরুদ্ধে আদালতের এই আদেশ নতুন করে চিন্তার জন্ম দিচ্ছে।
এখন প্রায় সব ধরনের ওষুধই দেশে তৈরি হচ্ছে। যক্ষ্মা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, হেপাটাইটিসসহ আরও অনেক জটিল রোগের ওষুধও বাংলাদেশে তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। দেশের চাহিদা পূরণ করে বছরে সাড়ে ৫শ’ কোটি টাকারও বেশি ওষুধ রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। এদেশের ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে ১০৯টি দেশে। তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ইউরোপের অনেক দেশও আছে। উন্নয়নশীল ৪৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পই সবচেয়ে এগিয়ে।
কিন্তু ওষুধ উৎপাদনে এমন সাফল্য আমাদের গৌরবান্বিত করে। আবার মানসম্মত উৎপাদন প্রক্রিয়া না মানায় ২০ কোম্পানির বিরুদ্ধে এই আইনি ব্যবস্থা আমাদের ভাবিয়ে তোলে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত মান মেনে ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে ২০১৪ সালে গঠিত হয় বিশেষ কমিটি। এই কমিটি দেখেছে, ৩৪টি কোম্পানির উৎপাদন মান সন্তোষজনক নয়। অথচ এদের অনেকেই জীবন রক্ষাকারী অ্যান্টিবায়োটিকও তৈরি করছিল। দুবছর পর হাইকোর্টের নির্দেশনা পাওয়া গেল। তার কঠোর বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
একটি মানবাধিকার সংগঠন রিট না করলে হয়তো আমরা জানতেও পারতাম না, দেশে মানহীন ওষুধ উৎপাদন হয়। কোনোদিন এদের উৎপাদন বন্ধও হয়তো হতো না। তার অর্থ হলো, নজরদারি কতটাই না দুর্বল।
এখানেই প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসে ওষুধনীতির কথা। তিন দশকের বেশি পুরনো নীতিমালা দিয়ে চলছে দেশের বিকাশমান ওষুধশিল্প। এ শিল্প দ্রুত বিকশিত হলেও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওষুধনীতির আধুনিকায়ন করা হয়নি। এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেশিয় বাজারে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ সহজে ঠাঁই করে নিচ্ছে। রোধ করা যাচ্ছে না লাগামহীন উচ্চমূল্য। পুরনো নীতিমালার বাধ্যবাধকতায় ওষুধের মান ও কার্যকারিতা নিয়েও ক্রেতারা কোনো তথ্য জানতে পারছেন না। ওষুধশিল্প নিয়ন্ত্রণে ১৯৮২ সালে সর্বশেষ আইন করা হয়। বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও ওষুধনীতি আধুনিকায়নে বিভিন্ন সরকার উদ্যোগ নিলেও প্রভাবশালীদের চাপে শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। সর্বশেষ ২০০৫ সালে একটি জাতীয় ওষুধনীতি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয় সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে জাতীয় ওষুধনীতির একটি খসড়া প্রস্তুত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু এরপর আড়াই বছর পেরিয়ে গেলেও এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ওষুধের নকল, ভেজাল ও উচ্চমূল্য রোধ, কাঁচামালের উৎপাদন ও আমদানি সহজ করতে যুগোপযোগী ওষুধনীতি প্রয়োজন। ১৯৮২ সালে যে বাস্তবতা ও প্রেক্ষাপটে ওষুধনীতি করা হয়েছিল, এখনকার বাস্তবতা তার থেকে আনেক আলাদা। তাই একটি যুগোপযোগি জাতীয় ওষুধনীতি এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কার্যকর ওষুধনীতির অভাবে আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা চড়া দামে ওষুধ বিক্রি করছেন। বাজারে নকল ও ভেজাল ওষুধও বিক্রি হচ্ছে।
লেখক : পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন