নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও পলাশীর যুদ্ধ
তানভীর আহমেদ
বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন নবাব আলীবর্দী খাঁর দৌহিত্র। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আ¤্রকাননে সংঘটিত যুদ্ধে পরাজয় এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর মৃত্যুর পর ভারতবর্ষে বৃটিশ শাসনের সূচনা ঘটে। তাই ঐতিহাসিকভাবে নবাব আলীবর্দী খাঁ ও নবাব সিরাজউদ্দৌলার শাসনকাল এবং পলাশীর যুদ্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলে বিবেচিত। প্রকৃতপক্ষে পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতবর্ষের ইতিহাসের মোড় ঘুরে যায়। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা, ক্ষমতার প্রতি মোহ, অর্থের প্রতি লোভ ও চারিত্রিক অধঃপতন ছিল নবাব পরিবারের বৈশিষ্ট্য। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হ’ল যে, শঠতা ও কূটচালের মাধ্যমে নবাব আলীবর্দী খাঁ যেভাবে নবাব সরফরাজ খাঁকে পরাজিত ও হত্যা করেছিলেন ঠিক একইভাবে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ক্ষমতা ও পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।
নবাব আলীবর্দী খাঁর শাসনকালে তিনি অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছিলেন মারাঠীদের আল্ডমণ মোকাবেলায়। নিজের পরিবারের প্রতি তিনি উদাসীন না হলেও অনেক অযাচিত ঘটনার সম্মুখীন তাকে হতে হয়েছিল। এর মধ্যে সিরাজউদ্দৌলা কর্তৃক আযিমাবাদ-পাটনা অবরোধ অন্যতম। মাতামহ আলীবর্দী দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলাকে তার উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে দৌহিত্রের এই অবাধ্যতার সমাপ্তি ঘটান। কিন্তু এই ঘোষণা সিরাজকে মসনদপ্রত্যাশী অন্যদের নিকট চক্ষুশূল করে তোলে। এছাড়া রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও ষড়রিপুর জন্য খ্যাত সিরাজকে পরবর্তী উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করার ঘোষণা পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের আতঙ্কিত করে তোলে। তবে এ সময় এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যায় যার ফল সিরাজকে ভোগ করতে হয়েছিল। নবাব আলীবর্দী খাঁ তাঁর জ্যেষ্ঠ জামাতা নওয়াযিশ মোহাম্মদ খানকে জাহাঙ্গীরনগরের নায়েবে নাযিম নিযুক্ত করেছিলেন। এছাড়া তাকে সহায়তা করার জন্য আলীবর্দী খাঁ হোসেনকুলী খান নামের তার একজন দক্ষ সভাসদকে নিযুক্ত করেন। নওয়াযিশ মোহাম্মদ খানের স্ত্রীই ছিলেন আলীবর্দী খানের জ্যেষ্ঠা কন্যা মেহের-উন-নিসা যিনি ঘসেটি বেগম বলে পরিচিত। হোসেনকুলী খান জাহাঙ্গীরনগরে না থেকে মুর্শিদাবাদে অবস্থান করে তার দাপ্তরিক কাজ চালাতেন। কিন্তু নায়েবে নাযিমের সাথে সুসম্পর্কের পাশাপাশি তিনি (হোসেনকুলী খান) নায়েবে নাযিমের স্ত্রী ঘসেটি বেগমের সাথেও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তোলেন যা শালীনতার সীমা অতিল্ডম করে যায়। পরবর্তী সময়ে এ সম্পর্ক সিরাজের মা আমিনা বেগম পর্যন্ত গড়ায়। বিষয়টি নিয়ে নবাব আলীবর্দী খাঁ ও তার স্ত্রী শরফ-উন-নিসা খুব বিচলিত হয়ে পড়েন। নবাব পরিবারের এ কলঙ্ক মোচনের দায়িত্ব আলীবর্দী খাঁ সিরাজউদ্দৌলাকে দেন। সিরাজ জাহাঙ্গীরনগরের রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে হোসেনকুলী খানকে হত্যা করেন। এ ঘটনায় সিরাজের শত্রু ও মিত্র পক্ষ নির্ধারিত হয়ে যায়।
বাংলার মসনদে রাজা, সুলতান, সুবেদার ও নবাবসহ যতজন শাসক আরোহণ করেছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন তাদের সবার মধ্যে ব্যতিল্ডম। কারণ রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ কম বয়সী সিরাজের দেশপ্রেমে কোনো ঘাটতি ছিল না। তাছাড়া সিংহাসনে আরোহণ করার পর তিনি নিজেকে পুরোপুরি পাল্টে ফেলেন। মাতামহ আলীবর্দী খাঁ মৃত্যুশয্যায় তাকে যেসব নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন তা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে কিছু নির্দেশনা তার বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একমাত্র মাতামহের নির্দেশনার জন্যই সিরাজ তার নিজ পরিবারের বিশ্বাসঘাতক সদস্যদের বিরুদ্ধে সঠিক সময়ে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হন। বাংলার মুঘল সুবেদার শাহ সুজার নিকট থেকে কৌশলে ইংরেজরা ১৬৫১ সালে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতি আদায় করার পর থেকে তারা বাংলায় একচেটিয়া বাণিজ্য করতে থাকে। এটি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলার সুবেদারদের সাথে ইংরেজদের বিরোধ তৈরি হয়। এ বিরোধ পরবর্তীকালে সংঘর্ষ ও শেষে যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায়।
লেখক: সহকারী পরিচালক, কমিউনিকেশন্স এন্ড পাবলিকেশন্স বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক
সম্পাদনা: জব্বার হোসেন