নিজেকে নয়, জনগণকে নিয়ে ভাবুন
সংসদ সদস্যগণ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হওয়ায় তাদের জনপ্রতিনিধি বলা হয়। প্রতিটি সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা চলাকালীন সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীগণ ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য সার্বিকভাবে এলাকার উন্নয়ন এবং এলাকাস্থিত জনগণের কল্যাণ ও মঙ্গলার্থে গৃহিতব্য কার্যক্রমের কথা বলে থাকেন। দেশে সাধারণ জনমানুষ এ ধরনের আশ্বাস দ্বারা আশ্বস্ত হয়ে এলাকার উন্নয়ন ও নিজের কল্যাণ এবং মঙ্গলের কথা ভেবে ভোট দিয়ে থাকেন। কিন্তু পরবর্তীতে যখন নির্বাচিত হন তখন তার সাক্ষাৎ মেলা অনেক কঠিন।
একটি নির্বাচনি এলাকার উন্নয়নের জন্য সরকারের পক্ষ হতে প্রতিবছর যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা একজন সংসদ সদস্যের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কার্যকর হয়। তাছাড়া সংসদীয় এলাকাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরিসহ স্কুল ও কলেজে ছাত্র ভর্তি এবং শিক্ষক নিয়োগে একজন সংসদ সদস্যের সর্বময় কর্তৃত্ব বহাল থাকে। দেশের জনসাধারণের পক্ষ হতে প্রায়শই অভিযোগ পাওয়া যায়, নিজ দল বা অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী না হলে সংসদ সদস্যের নিকট হতে সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে তাকে অন্যভাবে সন্তুষ্ট করার আবশ্যকতা দেখা দেয়। অনেক সময় জনসাধারণকে বলতে শোনা যায়, তাকে নিঃস্বার্থভাবে ভোট দিয়েছি, কিন্তু আমরা রাজনীতি সংশ্লিষ্ট না হওয়ার কারণে আজ ন্যায্যভাবে কিছু চাইতে গেলেও কোনো বিনিময় যোগ না থাকলে তা হতে বঞ্চিত করা হয়। অতীতে দেশে যারা রাজনীতি করতেন তারা নিজের ভাগ্যোন্নয়নের চেয়ে দেশ ও জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন নিয়েই বেশি ভাবতেন। এখনকার রাজনীতিবিদরা বিশেষত সংসদ সদস্যরা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন নির্বাচিত হওয়া পরবর্তী ৫ বছরের ব্যাপ্তিকালে তিনি তার চেয়ে কয়েকগুণ অধিক অর্থ আয় করে থাকেন। আর তাই অনেক ব্যবসায়ীকে বলতে শোনা যায়, যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে সংসদ সদস্য হয়ে যে সকল বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায় ব্যবসার ক্ষেত্রে সমবিনিয়োগ এর কিয়দংশেরও নিশ্চিতয়তা দিতে পারে না।
ঢাকা বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহর। এ শহরটিতে যারা বসবাস করে তাদের অধিকাংশই উপযুক্ত গৃহায়নের অভাবে অনেকটা মানবেতন জীবনযাপন করে। ঢাকা শহরের বর্তমান যে অবস্থা তাতে সরকারিভাবে কোনো ব্যক্তির অনুকূলে গৃহ নির্মাণের নিমিত্ত ভূমি বরাদ্দের সুযোগ নেই। এ বাস্তব উপলব্ধি হতেই গত বছর সরকারের পক্ষ হতে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, এখন হতে প্লটের পরিবর্তে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হবে। সরকারের এ ঘোষণা শুনে দেশবাসী আশ্বস্ত হয়েছিল, শহরাঞ্চলে ভূমির সর্বাত্মক ব্যবহারের মাধ্যমে অপচয় রোধ হবে। কিন্তু গত ২০ জুন, ২০১৬ খ্রি. পূর্তমন্ত্রী যখন বাজেট বক্তৃতাকালীন বলেন, রাজউকের অধীন যে এক লাখ এ্যাপার্টমেন্ট নির্মিত হতে যাচ্ছেÑ তাতে সংসদ সদস্যদের সহজ শর্তে ক্রয়ের সুবিধা দেওয়া হবে। মন্ত্রীর এ ঘোষণা শুনে সমস্বরে সংসদকক্ষে উপস্থিত সব সংসদ সদস্য না না বলে উঠেন এবং তারা প্লট ও ফ্ল্যাট উভয়ের বরাদ্দ চান। অতঃপর অনেকটা বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে মন্ত্রীকে সংসদ সদস্যদের আশ্বস্ত করতে হয়, তারা প্লট ও ফ্ল্যাট দুটোই পাবেন। মন্ত্রীর এমন আশ্বাসে সংসদ সদস্যদের মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে ওঠে।
আমাদের যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা সংসদের মাধ্যমে গৃহিত ও অনুমোদিত হয়। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র অভ্যুদ্বয় পরবর্তী ঢাকা শহরে সরকারিভাবে যে সকল আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছিল, এর কোনোটিই সময়ের পরিক্রমায় তার আবাসিক চরিত্র ধরে রাখতে পারেনি। ধানমন্ডি ও গুলশান আবাসিক এলাকায় যখন ৫ ও ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে এক বিঘা ভূমির বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, তখন কেউ কি ভেবেছিল ৩০ বছর না পেরুতেই এ ভূমির মূল্য আকাশচুম্বী হবে। ধানমন্ডি ও গুলশান আবাসিক এলাকা সৃষ্টিকালীন রাজধানী শহর ঢাকায় ভূমির ওপর যে চাপ ছিল, আজ তা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় সরকারিভাবে ঢাকা বা ঢাকার অদূরে প্লট বরাদ্দের কোনো সুযোগ নেই। আমাদের সংসদ সদস্যদের নিজেকে নিয়ে না ভেবে দেশের জনগণের কথা ভাবতে হবে। আর দেশের জনগণের কথা ভাবনায় নিলে তাদের পক্ষে প্লটের বরাদ্দ চাওয়া যে সমীচীন নয় এ বোধদ্বয় তাদের হবে কি?
লেখক : সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন