বেনারসি শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত কারিগররা
শেরপুর (বগুড়া) প্রতিনিধি : ঘুমে চোখের পাতা নুয়ে আসতে চায়। এপাশ-ওপাশ করতে করতে হাত আর চলে না। একটানা ব্যবহারে পা দু’টিও যেন অবশ হয়ে আসে। এরপরও দম ফেলার ফুরসত নেই। বিরামহীন বেনারসিপল্লীতে রাত-দিন বেজে চলেছে খট খট শব্দ, তৈরি হচ্ছে উন্নতমানের নানা ধরনের নানা নামের বেনারসি শাড়ি।
দরজায় কড়া নাড়ছে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব ঈদ-উল ফিতর। আর তাই রাত-দিন এক করে রকমারি ডিজাইনের বেনারসি শাড়ি তৈরির কাজে মহাব্যস্ত বেনারসি পল্লীর কারিগররা। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে বলে তাদের বসে থাকারও কোনো উপায় নেই। ঈদের চাহিদা মেটাতে উন্নতমানের এসব শাড়ি তৈরি হচ্ছে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ঘোলাগাড়ি কলোনি গ্রামের বেনারসি পল্লীতে।
এ পল্লীতে শাড়ি বুননের কাজ চলে সেহরি খাওয়ার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত । কাজগুলো কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন করেন কারিগররা। ফিনিশিংয়ের আগে প্রত্যেকটি শাড়িতে পড়ে নারীর হাতের কোমল পরশ। সেই কোমল পরশে রং-বেরঙের হাজারো সুতোর বন্ধনে হয়ে ওঠে একেকটি আকর্ষণীয় শাড়ি। তবে সমস্যাও রয়েছে। এখানে উন্নতমানের শাড়ি তৈরি করা গেলেও ফিনিশিংয়ের কাজ করার কোনো প্রযুক্তি নেই। এ কারণে মালিকদের শাড়ি নিয়ে ঢাকার মিরপুর বেনারসি পল্লীতে ছুটতে হয়। সেখান থেকে প্রতিটি শাড়ি ব্যবহার উপযোগী করে নিয়ে আসা হয়। এরপর তা বাজারজাত করা হয়।
ঘোলাগাড়ি কলোনি বেনারসি পল্লীতে শাড়ি তৈরির কারখানার মালিক ও কারিগরদের সঙ্গে কথা হলে এমন সব তথ্য উঠে আসে। বগুড়া জেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এ বেনারসি পল্লীতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মাটির ওপর বিশেষ পদ্ধতিতে শাড়ি তৈরির কারখানাগুলো গড়ে তোলা হয়েছে। প্রত্যেক কারখানায় একটি নির্দিষ্ট স্থানে মাটি কেটে চারকোনা আকৃতির গর্ত সৃষ্টি করা হয়েছে। সেই গর্তে কারিগররা বসে মেশিন পরিচালনা করেন। মেশিনে লাগানো রয়েছে বাহারি ডিজাইনের ক্যাটালগ। সামনে রয়েছে নানা রংয়ের লাখো সুতোর বান্ডিল। কারিগরের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় এসব সুতোই একটা সময় হয়ে ওঠে আকর্ষণীয় শাড়ি। বেনারসি শাড়ি কারখানার মালিক আব্দুল ওয়াহেদ জানান, ১৯৮০ সালে তিনিই প্রথম এই গ্রামে শাড়ি বুননের কাজ শুরু করেন। বেনারসি তৈরির জন্য ঢাকার মিরপুর থেকে দু’টি মেশিন কেনেন। সঙ্গে কেনেন শাড়ি বুননের জন্য সুতো, জড়ি, কেলা, তানি, রংসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম।
পরে নিজ বাড়িতে গড়ে তোলেন বেনারসি তৈরির কারখানা। তখন একেকটি কারখানার পেছনে ২০-২২ হাজার টাকার মতো ব্যয় করতো হতো।
তিনি আরো জানান, একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কারখানা তৈরিতে তিনটি ধাপের প্রয়োজন হয়।
আব্দুল জব্বার, মোবারক হোসেন, আব্দুল আহাদ, জাহেদ আলীসহ একাধিক কারিগর জানান, শুরুর দিনগুলোতে একেকটি বেনারসিতে তৈরিতে কমপক্ষে সপ্তাহখানেক সময় লাগতো। কারণ, তখন আলো ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা ছিলো না। গ্রামীণ অবকাঠামোর সমস্যা ছিলো প্রকট। কিন্তু অনেক আগেই এ গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। রাস্তা-ঘাটও আগের তুলনায় অনেকটা ভালো হয়েছে। ফলে ২-৩ দিনেই ৩ জন কারিগরের সমন্বয়ে এখন একেকটি পূর্ণাঙ্গ শাড়ি তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে।
কারখানার মালিকরা জানান, ১৯৯০ সালের পর থেকে এ শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে। ফলে গ্রামের নারীরাও এ পেশার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে ফেলেন।
রোকেয়া আক্তার, জাহানারা বেগম ও উম্মে সালমা বলেন, এ গ্রামের সিংহভাগ নারী সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে শাড়ি বুননের কাজ করেন। কারণ, এ থেকে সংসারে বাড়তি আয় আসে। এতে সংসারের অভাবও অনেকটা দূর হয়।
এসব নারীরা জানান, এখানে বেনারসি বুটিক, জামদানি, ব্রকেট, টাইটাকি পারআঁচল, কাতান, কাতান বুটিক, পাটি নামের বাহারি ডিজাইনের শাড়ি তৈরি করা হয়। যে শাড়িতে প্রত্যেক বাঙালি নারীর প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। বেনারসি গায়ে জড়িয়ে গর্বে ভরে ওঠে নারীর মন-প্রাণ।