‘দারিদ্র্যের ‘দুষ্ট চক্র’ থেকে মানুষকে তুলে আনতেই পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক’
দীপক চৌধুরী : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ক্ষুদ্র ঋণের জাল অনেক সময় দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্রের মতো দরিদ্র মানুষকে সহায়, সম্বলহীন, নিঃস্ব করে দেয়। এ কারণে আমরা মাইক্রোক্রেডিটের দর্শন পাল্টে মাইক্রোসেভিংস বা ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের উপর জোর দিয়েছি। এই প্রণোদনামূলক ব্যবস্থাই পারে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যের মূলোৎপাটন করতে।
গতকাল বুধবার গণভবনে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের আগে এসব কথা বলেন, শেখ হাসিনা। এরপর তিনি পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ১০০টি শাখা একসঙ্গে উদ্বোধন করেন। পল্লী অঞ্চলের দরিদ্র জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে তাদের অর্থনৈতিক সঞ্চয় নিশ্চিত করতে সারাদেশে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়েছে।
ঋণের ওই জাল থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশের গ্রামের দরিদ্র মানুষদের স্বাবলম্বী হতে ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প’ ও ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক’কে অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
‘উচ্চ সুদের জালে’ দরিদ্র মানুষকে জড়িয়ে ফেলার কারণ উল্লেখ করে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের সমালোচনা আবারও করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, একসময় আমি নিজেও মাইক্রোক্রেডিটের পক্ষে বলতাম। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম, যারা ঋণ নিচ্ছে এবং সপ্তাহ শেষে ওই ঋণের টাকা শোধ দিতে হচ্ছে, সে কোনো স্থায়ী কর্মসূচি নিতে পারছে না, স্থায়ী কর্মকা- যে করবে সে সুযোগ তার নাই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারণ তাকে উচ্চহারে সুদ দিতে হচ্ছে। ফলাফলটা দাঁড়াচ্ছে, যারা এ সুদটা দিচ্ছে বা ব্যবসা করছে তারা যতটা লাভবান হচ্ছে, দরিদ্র জনগোষ্ঠী; তারা কিন্তু ওখান (দরিদ্রতা) থেকে বের হতে পারছে না।
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে প্রতিটি বসতবাড়িকে একটি খামার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যে উদ্যোগ নেয়া হয়,পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক সেই একটি বাড়ি একটি খামারেরই প্রাতিষ্ঠানিক রুপ। যে ব্যাংকের মালিক হচ্ছে যৌথভাবে গ্রামের সমিতিভুক্ত প্রান্তি আয়ের নারী-পুরুষ ও সরকার।
তিনি একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসল কীভাবে সমিতির মাধ্যমে বাজারজাত করা যায় এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে সমন্বয় রেখে খাদ্য ও কৃষি প্রক্রিয়াজতকরণ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গড়ে তোলা যায়, সে বিষয়েও গুরুত্ব দেন।
প্রথম মেয়াদে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সময় স্বল্প পরিসরে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প শুরু করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে তা বন্ধ করে দেয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক সময় অনেকে ঋণের টাকা দিতে পারছে না বলে হয় আত্মহত্যা করছে, নয়ত তাদের ঘরবাড়ি সব বিক্রি করে দিয়ে অথবা যা কিছু আছে সব বিক্রি করে দিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।
অথবা একটার পর একটা ঋণ নিয়ে ওই ঋণের জালে সবসময় তারা জড়িয়ে থাকছে। ঋণগ্রস্ত হয়েই তাদের জীবনটা কাটাতে হচ্ছে, তারা কখনোই নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে না।
এ অবস্থা দেখেই ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প তৈরির চিন্তা মাথায় আসে বলে অনুষ্ঠানে জানান শেখ হাসিনা।
২০০৮ সালে শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায় ফিরলে প্রকল্পটি পুনরায় শুরু হয়। বর্তমানে সারাদেশে এ প্রকল্পের আওতায় প্রায় সাড়ে ২২ হাজার সমিতির মাধ্যমে প্রায় ২৩ লাখ পরিবার সম্পৃক্ত।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে সঞ্চয়কে উৎসাহিত করে গ্রামীণ জনপদে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সঞ্চয় ও অর্জিত অর্থ লেনদেন ও রক্ষণাবেক্ষণ, ঋণ ও অগ্রিম প্রদান এবং বিনিয়োগের জন্য পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে সরকার।
এ ব্যাংকের ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিকানায় রয়েছে সরকার এবং বাকি শেয়ারের মালিকানা সংরক্ষিত রয়েছে একটি বাড়ি একটি খামার সংশ্লিষ্ট সমিতি ও অনুরূপ সমিতির জন্য।
গ্রামীণ অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সরকার মনে করে গ্রামের অর্থনীতি যদি শক্তিশালী হয়, মজবুত হয়, সেখানে যদি অর্থ সঞ্চিত থাকে, তার সুফল সারাদেশ পাবে এবং দ্রুত দারিদ্র্য বিমোচন হবে।
তিনি বলেন, অর্থাৎ তার টাকাটা তারই থাকল। ওই ঋণের (ক্ষুদ্র ঋণ) সুদ নিতে গিয়ে তাকে কেউ ঘরবাড়ি হারা করতে পারবে না, নিঃস্ব-রিক্ত করতে পারবে না। এই সঞ্চয়টা তার ব্যক্তি হিসেবে যতটা থাকছে, পাশাপাশি রাষ্ট্রের সার্বিক অর্থনীতিতে বিরাট একটা অবদান রাখছে। অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যেÑঢাকা সিটি কর্পোরেশনের দুই মেয়র মো. আনিসুল হক এবং সাঈদ খোকন, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম এবং ড.মশিউর রহমান,বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ফজলে কবীর, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. আবুল কালাম আজাদ, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাড. দীপু মনি, অ্যাড. রহমত আলী এবং পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান মিহির কান্তি মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও সিলেটে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের উপকারভোগীদের সঙ্গেও কথা বলেন।