ভিনদেশে রমজান
মাওলানা মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
সিওও, আইটিভি নিউইয়র্ক
সহকারী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
আমেরিকায় রমজানের গুরুত্ব সম্মান অন্যরকম। এখানকার সব ধর্মের মানুষই মুসলিমদের রোজাকে গুরুত্ব দেয়। অফিস আদালতে দেয়া হয় বাড়তি সুযোগ। রাষ্ট্রীয়ভাবে ইফতার মাহফিলেরও আয়োজন করা হয়। হোয়াইট হাউজে দেশের প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে পালিত হয় ইফতার মাহফিল। বিভিন্ন শহরের শাষকরাও নিজ উদ্যোগে ইফতার মাহফিল করে। বেশ আদর আপ্যায়ন করা হয় এসব মাহফিলে। পুরো রমজানই এখানে দেখা যায় সবার ভেতর সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ। মার্কেটগুলোতে ইসলামি পণ্য বাড়ানো হয়। হোটেলগুলোতে পরিবেশন করা হয় হালাল খাবার। এখানকার সব মসজিদেই ইফতারের আয়োজন থাকে। অনেক মসজিদ রয়েছে যেগুলোতে প্রতিদিন হাজারও মানুষকে ইফতার করানো হয়। বাঙালি কমিউনিটিগুলো প্রায় প্রতিদিনই ইফতার মাহফিলের আয়োজ করে থাকে। এছাড়া জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের উদ্যোগে প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১২ শ মানুষকে ইফতার করানো হয়। চলতি বছর সৌদি ও মিশর থেকে ১৫০ জন কারী এসেছেন তারাবি পড়াতে। বাংলাদেশ থেকেও প্রায় ২০ জনের মতো এসেছেন। সব মিলিয়ে এখানকার রমজানের পরিবেশ এবং শিক্ষাটা অতুলনীয়।
শায়খ আহমাদুল্লাহ
প্রিচার ও ট্রান্সলেটর, পশ্চিম দাম্মাম ইসলামিক সেন্টার, ইসলামিক অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রণালয়, সৌদি আরব
সৌদি আরবে রমজান মানে ঈদের আনন্দ। রমজানের চাঁদ উঠতেই শুরু হয় একে অন্যের কল্যাণ কামনা করে ক্ষুদেবার্তা বিনিময়। শহরগুলো সাজে নতুন সাজে। দান-দক্ষিণার নীরব প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয় সবার মাঝে। বেশিরভাগ লোক রমজানের রাতে জেগে থাকে। দোকান-পাঠ, শপিং মল, রোস্তোরাঁসহ অনেক অফিস-আদালতও সারা রাত খোলা থাকে। ফজরের পরে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। দিনের সকল ব্যস্ততা রাতের ব্যস্ততায় বদলে যায়। সৌদিতে রোজাদারকে ইফতার করানোর ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি দেখার মতো। মোড়ে মোড়ে স্থাপন করা হয় শিতাতপ নিয়ন্ত্রিত তাবু। বছর জুড়ে যেসব ভিনদেশী শ্রমিকরা সৌদিয়ানদের সেবায় নিয়োজিত থাকে, রমজান মাসে এসব তাবুতে দেখা যায় তার উল্টো চিত্র। মেহমান হয়ে বসে থাকে বাঙালি ইন্ডিয়ান ও অন্যান্য প্রবাসী রোজাদার শ্রমিক। আর খাদেমের মতো তাদের সামনে ইফতার আয়োজনে লেগে যায় কল্যাণকামী সৌদিরা। শেষ দশকে মসজিদগুলোর মাইক থেকে কিয়াম্ল্লুাইলের মধুমাখা তিলাওয়াতের সুর গোটা শহরকে মুখরিত করে রাখে। আল্লাহভীরুদের কান্নার রোল যে কোনো পাষাণকেও কোমল হতে বাধ্য করে।
মাওলানা শহীদুল ইসলাম ফারুকী
পিএইচডি ফেলো ও রিসার্চ এ্যাসিস্টেন্ট
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়ান মুসলমানরা ইবাদতে বেশ স্বাচ্ছন্দ। পরিচ্ছন্নতার দিক থেকেও এগিয়ে। এখানে রমজানের শুরুতেই মসজিদ ও ঘরদোর সাজসজ্জা করা হয়। নারীরা ঘরের ব্যবহার্য আসবাবপত্র কিনেন। রমজানে পাল্টে যায় পুরো মালয়েশিয়ার চিত্র। পথঘাট চেনার উপায় থাকে না। এমনভাবে সবকিছু সাজানো হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চলে রমজানের আগে। সড়কবাতির পাশাপাশি রমজানের সম্মানে আলোকসজ্জার ফলে দেশজুড়ে বিরাজ করে মনোরম পরিবেশ।
রমজান উপলক্ষে এখানে পারস্পরের মধ্যে শুভেচ্ছা বিনিময়ের সংস্কৃতি বেশ পুরনো। অভিবাদনস্বরূপ ‘শাহরুন মুবারাকুন’ এবং রমজান ও রোজার আয়াত বা হাদিসসংবলিত প্রীতিকার্ড বিনিময় করে থাকে। এছাড়াও মসজিদে মসজিদে পবিত্র রমজানের আগমন উপলক্ষে বিশেষ আলোচনা ও ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। রাস্তায় রাস্তায় বিশাল আকারের সাইরেনের মাধ্যমে রমজান আগমনের বার্তা ছড়ানো হয়। অন্যান্য মুসলিমদের সঙ্গে আমাদের রমজান বেশ স্বাচ্ছন্দেই কাটছে। এখানকার মুসলিরাও অনেক সাহায্যপরায়ন। একজনের বিপদে অন্যজন বেশ সহজেই এগিয়ে আসে।
পলাশ রহমান
পৌরোডিউচার, রেডিও বেইজ, ইতালি
আমার বাসা থেকে ভেনিসের বাঙালি পাড়া খানিকটা দূরে, প্রায় ৩০ কিলোমিটার। এখানে বাংলাদেশিদের নিয়ন্ত্রণে ৩টি মসজিদ আছে। ইসলামি কালচারাল সেন্টার নামে ভাড়া নেয়া ওই জায়গাগুলো মুসলমানরা মসজিদের মতো ব্যবহার করেন। সেখানে নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ হয়, রমজানের তারাবি হয়। প্রতি সন্ধ্যায় মুসল্লিদের ইফতারি করানো হয়। আমি এক মসজিদে ইফতার করলাম। সেখানে প্রায় আড়াই’শ মুসল্লিকে দেখলাম একসাথে ইফতারি করতে। এদের মধ্যে বড় একটা অংশ যুবক।
ইতালিতে ইফতারির বিশেষ কোনো মেনু নেই। বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসন গ্রহণ করা মুসলমানরা নিজ নিজ দেশের খাদ্যাভ্যাস মতো ইফতারি করেন। সাথে স্থানীয় ফল এবং পাস্তা খান অনেকে।
ইতালি ক্যাথলিক প্রধান দেশ। এখানে মুসলামদের কোনো ধর্মীয় উৎসবে ছুটি হয় না। রোজার মাসেও কাজের সময়ে এতটুকু তারতম্য ঘটে না। সবই চলে বছরের অন্যান্য সময়ের মতো। ভারি কাজের কারণে অনেকেরই রোজা রাখতে কষ্ট হয়। কিন্তু কেউই রোজা ছাড়েন না। আমার এক বন্ধু আছেন যিনি একটি রেস্টুরেন্টের পিজার শেফ। যে চুলাটার সামনে দাড়িয়ে তাকে কাজ করতে হয়, তার তাপমাত্রা কম করে হলেও ৩৫০ ডিগ্রী। তবুও তিনি রোজা রাখেন। তবে এখানকার অধিকাংশ কাজের মালিকরা রোজা রাখা পছন্দ করে না। তাদের অপছন্দের কারন একটাই রোজা রাখলে শ্রমিক দূর্বল হয়ে পড়বে, কাজের ব্যঘাত ঘটবে।
মুহাম্মদ লুতফেরাব্বি
এমফিল গবেষক, আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো মিসর
মিসর ঐতিহ্যবাহী মুসলিমপ্রধান দেশ। এখানে রমজান বাংলাদেশের মতই আনন্দ ও উৎসবমুখর পরিবেশে কাটে। তবে কয়েকটি বিষয় আলাদাভাবে উল্লেখ করার মত।
১. কুরআন তেলাওয়াত ও চর্চা। রমজানে ঘরে-বাইরে সর্বত্র ব্যাপকভাবে এর প্রসার দেখা যায়। মসজিদগুলো চব্বিশ ঘন্টা খোলা থাকে এবং মানুষ দীর্ঘ সময় মসজিদে ইবাদত তেলাওয়াতে কাাঁয়। এমনকি ছোঁ ছোঁ বাচ্চারাও কয়েক খতম দেয়। ২. দান সদকা ও ইফতার বিতরণ। রমজানে কিছু জিনিসের দাম বাড়লেও দ্রব্যমূল্য সামগ্রিকভাবে সহনীয় পর্যায়ে থাকে। ধনীরা রমজানের আগে থেকেই গরিবদের মাঝে চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করে থাকেন। এখানে ইফতার মাহফিল সংস্কৃতি নেই বললেই চলে। বরং বড় বড় মসজিদ ও সেবা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে সর্বস্তরের মানুষের জন্য পুরা রমজানব্যাপী ‘মায়েদাতুর রহমান’ এর আয়োজন করা হয়। এছাড়াও পথেঘাটে সর্বত্র ইফতার বিতরণের চিত্র ব্যাপকভাবে দেখা যায়। কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও সামগ্রিকভাবে মিসরে রমজান উপভোগ্য।
কে আই ফেরদৌস
শিক্ষক, এমকেজেএম, ইভনিং মাদরাসা মিলটন কিন্স, বৃটেন
তেত্রিশ বছরের ইতিহাসে এবারই বৃটেনে সবচেয়ে লম্বা দিনের রমজান কাঁছে। প্রায় উনিশ ঘন্টার দীর্ঘ একটি দিন শেষে ইফতার করতে হয় এখানকার মুসলিমদের। তারপরও কারো কাছে কষ্টকর মনে হচ্ছে না এটাকে। উৎসবমুখরভাবেই রমজান পালন করছেন বৃটেনের ২৮ লাখ মুসলমান। বৃটেনের জনসংখ্যার পাঁচ ভাগ মানুষ রোজা রাখেন। তারাবিহ নামাজ পড়েন সাচ্ছন্দে। পরিবারের ছোঁ বড় সবাই ছুটেন মসজিদে। অনেক মসজিদে নারীরাও অংশ নেন। তারাবিহ নামাজের আগে পরে সবক’টি রোডে মুসল্লিদের উপস্থিতি দেখলে মনেই হয় না এটা বৃটেনের কোন শহর বা রাস্তা, এ যেনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কোনো দেশের অঞ্চল! আলহামদুলিল্লাহ বৃটেনের প্রায় প্রতিটা শহরেই রয়েছে একাধিক মসজিদ। কোনো কোনো শহরে তো প্রায় প্রতি রাস্তার মোড়ে মোড়েই একটা মসজিদ। প্রতিটা মসজিদই মুসল্লিতে ভরপুর। অধিকাংশ মসজিদেই তারাবি হয় দুই দফায়। যারা রাতে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট, টেকওয়েতে কাজ করেন তাদের জন্য দ্বিতীয় জামাত। অধিকাংশ মানুষই সেহরি খেয়ে একবারে ঘুমান।
মাওলানা ইমরান আনোয়ার
শিক্ষার্থী, কাতার বিশ্ববিদ্যালয়
কাতারে রমজানের পরিবেশ অন্যরকম। পুরো রমজানজুড়ে ঈদ আমেজ লেগে থাকে। ইবাদত বন্দেগিতে ব্যস্ত থাকে সাধারণ মানুষ। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আলোকসজ্জা করা হয় পথঘাট। সবমিলিয়ে অন্যরকম পরিবেশ সৃষ্টি হয় রমজানে। কাতারের অধিবাসীরা এমনিতেই ইবাদত বন্দেগি পরায়ন। বেশিরভাগ জায়গাতেই ৮ রাকাত তারাবিহ পড়া হয়। আমরাও আট রাকাতই পড়ি। আর কিছু কিছু জায়গাতে ২০ রাকাত তারাবিহর সাথে সাথে পবিত্র কুরআনও খতম দেয়া হয়। অবশ্য ৮ রাকাতের পর উপমহাদেশ থেকে আসা প্রবাসীরা বাকি ১২ রাকাত নিজে নিজে পড়ে নেন। এছাড়া অন্যান্য জায়গায় ইমামগণ সাধারণত নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী প্রথম দশ পারা, দ্বিতীয় দশ পারা; এভাবে যেকোনো যায়গা থেকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিদিন পড়ে যান। চার রাকাত শেষে আমাদের দেশের চেয়ে একটু লম্বা বিরতি নিয়ে থাকি আমরা। কোথাও কোথাও স্বাভাবিক বিরতির পরেই পরের রাকাতের জন্য দাঁড়িয়ে যান ইমামরা। এ বিরতিটুকুর মাঝখানে ইমাম সাহেবগণ কখনো সখনো তালিম-বয়ান করেন।
গ্রন্থনা : রোকন রাইয়ান