আদৌ আমরা ধার্মিক কিনা
ৎ প্রদীপ বাগচী
পশুপাখি থেকে মানুষকে আলাদা করেছে মানুষের অন্তনির্হিত গুণাবলি। পশুর আচরণ থেকে উন্নত আচরণ করতে পারলেই একজন মানুষ তখন মানুষ হয়ে ওঠে। মানুষকে মানুষরূপে ধরে রাখার জন্য যুগেযুগে এই পৃথিবীতে বিভিন্ন মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে। সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান অত্যন্ত জরুরি। মানব হিতৈষী এই মহাপুরুষগণ যুগেযুগে বিভিন্ন বাণী ও নীতিমালা প্রদান করে সমাজের মঙ্গল করার চেষ্টা করেছেন।
পরমেশ্বর ধ্যানে মগ্ন থেকে প্রাপ্ত বাণীও নীতিজ্ঞান-এর সংকলনকেই ধর্ম বলা হয়। ধর্মের লক্ষণ সম্পর্কে মনুসংহিতায় বলা হয়েছেÑ
অহিংসা সত্যমস্তেয়ং শৌচম্ ইন্দ্রিয়নিগ্রহঃ।
এতং সামাসিকং ধর্মং চতুর্বর্ণ্যহেব্রবীন্মনুঃ।। (১০/৬৩ )
মনুসংহিতায় প্রাপ্ত ধর্মের যে পাঁচটি সাধারণ লক্ষণ পাওয়া যায় তা যদি কোনো মানুষ পালন করে তবে তাকে ধার্মিক বলা যাবে। নতুবা তাকে ধার্মিক বলা যাবে না। প্রত্যেক মানবের উচিত অন্তত এই পাঁচটি গুণ অর্জন করা। শ্লোকটির বাংলা অর্থ হচ্ছেÑ
হিংসা না করা, সত্যবাদী হওয়া, চুরি না করা, পবিত্র থাকা, এবং সংযমী হওয়া।
বর্তমান সময়ে সারা পৃথিবীতেই দেখা যাচ্ছে, ধর্ম নিয়ে অনেক বাড়াবাড়িই হচ্ছে। মনুসংহিতার বিচারে আমরা কয়জন ধার্মিক আছি। মনুসংহিতায় বর্ণিত এই পাঁচ গুণ অর্জনের বিরোধিতা কোনো ধর্মগ্রন্থেই নেই। অহিংসা মানে হিংসা না করা। বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান বাণীই হচ্ছে অহিংসা পরম ধর্ম। যা মনুসংহিতায় ধর্ম লক্ষণের প্রথম গুণ। আমরা যদি পরস্পর হিংসাবর্জিত হতে পারতাম তবে পৃথিবীর মানবসমাজের এই করুণ পরিণতি হয়না। দ্বিতীয় গুণের কথা বলা হয়েছেÑ সদা সত্য কথা বলা, সত্য কথা যদি আমাদের অভ্যাসে পরিণত করতে পারি তবেই সমাজের প্রতারণা-প্রবঞ্চনা থাকবে না। তৃতীয় গুণের কথা বলা হয়েছে চুরি না করা। আমাদের যদি অন্যের ধন-সম্পত্তির প্রতি লোভ না জন্মে তবে চুরি করার প্রবণতা বন্ধ হয়ে যায়। এই চুরি করার প্রবণতা থেকে সমাজের কত বিশৃঙ্খলা প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। চতুর্থ গুণ হচ্ছে পবিত্র থাকা। মনের মধ্যে কখনও কুচিন্তা বা কুভাবকে স্থান দেওয়া যাবে না; তবেই পবিত্র থাকা যাবে। ইসলাম ধর্মেও বলা হয়েছে পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ। অন্তর ও বাহিরে পবিত্র ভাব বজায় রাখতে না পারলে সেই মহান সৃষ্টিকর্তা অনন্ত-অনন্ত-অনন্ত গুণময় পরমেশ্বরের প্রতি বিশ্বাস বা আস্থা রাখা যায় না। অন্তর ও বাহিরের পবিত্রতা অত্যাবশ্যক। পঞ্চম গুণের কথা বলা হয়েছে, সংযমী হওয়া অর্থাৎ ষড়রিপু কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মৎ ও মাৎসর্য এবং অষ্টপাশকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা। আমরা সংযমী হতে পারি না বলেই এতো বিভ্রান্তি।
পরিশেষে বলতে চাই আমাদের এই প্রিয় পৃথিবীতে প্রায় সাতশ কোটি মানুষ বসবাস করি। কতিপয় ব্যক্তি বাদে বাকি সবাই আমরা কোনো না কোনো ধর্মের আওতাধীন এবং প্রত্যেকে নিজনিজ ধর্মকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবিদার। এই দাবি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যুক্তিতর্ক তো আছেই কখনও কখনও পশুশক্তিও প্রয়োগ করে থাকি। একবারও কি ভেবে দেখেছি, মনুসংহিতায় বর্ণিত ধার্মিক হওয়ার জন্য যে সাধারণ পাঁচটি গুণের কথা বর্ণনা করা হয়েছে তা আমাদের মধ্যে আছে কি না? অর্থাৎ, আমরা ধার্মিক কি না? বা আদৌ আমরা ধর্মের আওতায় পড়ি কি না?
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সহযোগী অধ্যাপক