অবতার ও দেব-দেবী
ৎ গোপাল কৃষ্ণ বাগচী
হিন্দু ধর্মে অবতারবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত। প্রকারান্তরে অন্যান্য ধর্মের মহাপুরুষদেরকেও অবতার বলে, মানে এবং শ্রদ্ধা করে। এটা হিন্দু ধর্মের উদারতা ও যৌক্তিকতা। হিন্দু ধর্মে দশাবতারের কথা আমরা জানি। এখানে একটি বিষয আলোচনার দাবি রাখে। সৃষ্টির প্রথমদিকে জলজ প্রাণী ও পরে স্থল প্রাণির আবির্ভাব ঘটে এবং অনেক পরে আসে মানুষ। দশাবতারের ক্রম দেখলে দেখা যায়, জলজ প্রাণিরূপে প্রথমে মৎস অবতার, তারপর স্থল প্রাণিরূপে কূর্ম ও বরাহ অবতার, পশু ও মানব সংমিশ্রণে নৃসিংহ অবতার, খর্র্বকায় মনুষ্যরূপে বামন অবতার এবং পরে সম্পূর্ণ মানবরূপে বাকিরা আসেন। তাহলে দাঁড়ায়, পৃথিবীর জীবজগৎ একদিনে সৃষ্টি হয়নি, বিবর্তনের ধারায় পৃথিবী বহুবছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর বর্তমান অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।
ঈশ্বর নিরাকার নির্গুণ ব্রহ্ম। আবার তিনিই যখন ইচ্ছে প্রকাশ করলেন তিনি বহু হবেন (একোহম্ বহুস্যাম) তখন স্বগুণ সাকার রূপ ধারণ করলেন। ঈশ্বরের এক একটি শক্তি বা গুণের সাকার রূপই দেব-দেবীর প্রকাশ। যেমন শক্তির রূপে আছেন দুর্গা, কালি, পার্বতী ইত্যাদি, বিদ্যার রূপে সরস্বতী, ঐশ্বর্যের রূপে লক্ষ্মী, ক্ষাত্রশক্তির রূপে কার্তিক, মৃত্যুর রূপে আছেন যম। দেব-দেবীর রূপকল্পনা মানুষের বিচিত্র রুচিকে তৃপ্ত করে। ঈশ্বরের আরাধনায় কোনো না কোনোভাবে প্রতীকের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। বস্তুতঃ ঈশ্বরের প্রতীকরূপে বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজার মাধ্যমে স্বয়ং ঈশ্বরেরই পূজা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মে শাস্ত্রীয় কর্মকা- মনস্তাত্মিক পটভূমিতে সাজানো। পূজকের মনমানসে জগতের প্রাকৃতিক প্রতিটি বস্তুই পবিত্র ও সূচিতায় ভরা। সাগর, নদ-নদী, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রকে এদের অধিষ্ঠাত্রী দেবতাদের পবিত্র শরীর কল্পনা করা হয়।
প্রতিমা পূজা, যজ্ঞ ও তীর্থ : বিদেশি বিজেতা আর্যদের ধর্ম হচ্ছে বৈদিক ধর্ম। অন্যদিকে ভারতবর্ষের মাটি ও জলই হচ্ছে লৌকিক ধর্মের প্রধান উপাদান। সে ধর্ম মাটি থেকে ওঠে এসেছে। এ দেশের জনগণ চিরদিনই কৃষিজীবী। তাই ভারতবর্ষের অসংখ্য লৌকিক দেবতা সেই অন্নদার বিকাশ। পূজার উপকরণ ও নৈবেদ্য হিসেবে ব্যবহার করে প্রকৃতির এবং কৃষিজ ফসল ও পণ্য। প্রকৃতি ও ঋতু ভেদে বিভিন্ন পূজার আয়োজন করে। এ দেশের প্রতিমা মাটির তৈরি, জলে তার বিসর্জন হয়। মানব শরীরও একসময় মাটি, জল ও বায়ুতেই মিশে যায়। সমগ্র সৃষ্টিই পঞ্চতত্ত্ব দ্বারা সৃষ্ট। পঞ্চতত্ত্ব হল ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরূৎ ও ব্যোম। এ জন্যে কেউ মারা গেলে বলা হয়, লোকটি পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়েছে। হিন্দুর কাছে পৃথিবী হচ্ছে অন্নদাত্রী। মাটি, জল, প্রকৃতি, বন, পাহাড় ও নদ-নদী মানুষের অস্তিত্বের জন্যই প্রয়োজন। তাই মাটির প্রতিমা (মূর্তি নয়) গড়ে হিন্দুরা প্রকৃতি ও পৃথিবীর পূজা করে। বিভিন্ন মূর্তি আসলে প্রতীক। ঈশ্বর চিন্তা করতে গেলে জগৎ থেকে কিছু উপাদান-উপকরণ গ্রহণ করা লাগে। যেমন অসীম কিছু ভাবতে গেলে আমাদের মনে গভীর নীলাকাশ বা বিশাল সমুদ্রের কথা প্রতীকী হয়ে ভেসে ওঠে। খ্রিস্ট ধর্মের ক্রুশ এক পবিত্র প্রতীক। ঈশ্বর সবকিছুতে, সবজায়গাতেই আছেন। তবু মন্দির, মসজিদ, গির্জা, তীর্থ এক পবিত্র প্রতীকরূপে গণ্য। এই প্রতিমা পূজা সবার জন্য আবশ্যিক, তা নয়। কিন্তু কেউ যদি বিগ্রহের মাধমে সহজে নিজের দিব্যভাব উপলব্ধি করতে পারে তাতে সায় আছে। ভক্ত প্রতীকের মাধ্যমে ঈশ্বরেরই আরাধনা করে, মূর্তির নয়। তা না হলে, পূজা শেষ হয়ে গেলে প্রতিমাকে বিসর্জন দেওয়া হতো না। বিগ্রহ ছাড়াও মনের মধ্যে ঈশ্বরের একটি প্রতীক কল্পিত হয়েই পড়ে। আমরা বৃন্দাবন বা ওয়াশিংটন না গেলেও তার একটা রূপ কল্পনায় এসে যায়। প্রতিমা পূজা ধর্মজীবনের শৈশব বা প্রথম অবস্থায় মানুষের সহায়ক মাত্র। এ অবস্থা অতিক্রম করে সাধক যখন আরও উঁচু স্তরে উন্নীত হয়, তখন প্রতিমা ছাড়াই প্রার্থনা বা ধ্যান করতে পারে, তখন তাকে বলা হয় নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা। তবে বেশিরভাগই প্রতিমা পূজোতেই উৎসর্গ করেন, সাধনায় এর উপরের স্তরে আর ওঠা হয় না। দেবালয়ে বা গৃহে পূজার্চনা, ধর্মীয় উৎসব, ব্রত, উপবাস, শাস্ত্রপাঠ ও শ্রবন এসবের মধ্যেই সাধারণ হিন্দু নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। বাস্তবিক পক্ষে নিরাকার নির্বিকার অসীম ঈশ্বরের চিন্তায় বেশিক্ষণ মনোনিবেশ রাখা সম্ভব হয় না। বরং প্রতিমার মাধ্যমে আরাধনায় ঈশ্বরের চিন্তাই করে, প্রতীকের নয়।
পূজা শব্দটিও অস্ট্রিক, সংস্কৃত নয়। আরাধনার সহায়ক হিসেবে মহাত্মা গান্ধীও বিগ্রহ-প্রথার সমর্থন করতেন। বিবেকানন্দও। মূলত লৌকিক বিশ্বাস হচ্ছে আদিম অধিবাসীদের ধর্ম। মাঝখানে আর্যদের উত্থানের সময় এরা পেছনে পড়ে গিয়েছিল। কারণ আর্যরা প্রতিমা পূজা করত না, বেদে তা নেই। তবে তারা যজ্ঞ করত। তাদের নিজস্ব দেব-দেবী ছিল। আদিবাসীদের সংস্পর্শে এসে আর্যগণ একসময় বৈদিক দেবতাদের মূর্তি গঠনে এগিয়ে আসেন।
যজ্ঞে আর্যদের পশুবলী ও নানা আয়োজন ভূমিপুত্রদের কাছে জনপ্রিয় হয়নি। তাই আর্যরা পুরাণে যজ্ঞের বদলে তীর্থের বিধান দেয়। যজ্ঞে যে পূণ্য, তীর্থ ভ্রমণেও সে একই পূণ্য। তীর্থে মুক্তি বা তীর্থে স্বর্গপ্রাপ্তি। তীর্থ ব্যবস্থাটি অবশ্য বেদের কালের নয়। কালক্রমে হিন্দুদের মধ্যে তীর্থস্থান দর্শন ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। এগুলো এখন পরিণত হয়েছে মহামিলন ক্ষেত্রে। আর্য-অনার্যের সমন্বয়ের একটি উদাহরণও এটি। ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান হলেও যে স্থান থেকে যুগ যুগ ধরে সাধক ও তপস্বীগণ ঈশ্বরের সাধন-ভজন করেন, সে স্থান ক্রমে পবিত্র হয়ে জাগ্রত হয় এবং এর পরিবেশও পারমার্থিক উপলব্ধির অনুকূল হয়ে ওঠে। সে পরিবেশের আবেশে মনোমাঝেই তখন মন্দির তৈরি হয়। তাই তীর্থের এতো মাহাত্ম্য এবং তীর্থভ্রমণে এতো অভিলাষ। প্রকৃতপক্ষে হিন্দুদের কাছে ঈশ্বর অনন্তস্বরূপ হয়ে কেবল তত্ত্বজ্ঞানের মধ্যে আবদ্ধ নয়। হিন্দুদের ঈশ্বর, জগৎ সংসারের ঊর্ধ্বে পৃথক এক জগতে (স্বর্গে) বাস করেন না। তাদের ঈশ্বর প্রত্যেকের ভিতরে, সর্বরূপে- সর্বজীবে। হিন্দু মতে, ‘মানবাত্মা বা মানবদেহ ঈশ্বরের মন্দির।’ অন্য জীবজন্তুরাও ঈশ্বরের মন্দির বটে, তবে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ মন্দির। এ জন্য হিন্দুদের প্রার্থনা ‘সর্বেসত্তা সুখিতা ভবন্তু’Ñ অর্থাৎ জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক। কোনো মতাদর্শ বা গোষ্ঠীবদ্ধ জীবের জন্য এই প্রার্থনা নয়, সবার জন্য। তারা খ-িতাংশের মধ্যে নিজেদের কল্যাণ খোঁজে না, খোঁজে সমগ্রের মধ্যে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী