ৎ অসীম কুমার মন্ডল
চাঁদটা পূর্ণ আলোয় আলোকিত। আকাশে ঘনঘাঢ় সাদা মেঘ। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় মেঘগুলো ঝকমক করে উড়ছে। আকাশে রূপের খেলার সঙ্গে মানব প্রকৃতির খেলার সম্পূর্ণ বৈপরীত্য। আকাশে যে খেলা তা যেন খেলার প্রয়োজনে খেলা, সে খেলায় না আছে জয়, না আছে পরাজয়। জয়-পরাজয় এদুটোই মানুষকে মোহের দিকে টানে। মানুষের টান যদি নিচের দিকে থাকে তবে সে সংসার মায়ার ফাঁদে আটকে যায়।
মানুষ সংসারে থাকবে পদ্ম পাতার মতো, পদ্ম পাতা জলে থাকে তবুও তাতে জল স্পর্শিত হয় না। মানুষও তাই; সংসারে থাকবে ভোগ, সুখ, আসক্তি, যেন তাকে গ্রাস করতে না পারে তাই নিজের দৃষ্টিকে উর্ধ্বগামী করতে হবে। মানুষ জয়ী হলে খুশি, আর পরাজয় হলে দুঃখী।
…মানুষ সংসারে থাকবে পদ্ম পাতার মতো, পদ্ম পাতা জলে থাকে তবুও তাতে জল স্পর্শিত হয় না। মানুষও তাই; সংসারে থাকবে ভোগ, সুখ, আসক্তি, যেন তাকে গ্রাস করতে না পারে…আকাশে মেঘ হয় তা থেকে ঝরে পড়ে বৃষ্টি; বৃষ্টির ঠা-া শীতলতায় মানুষের আরামবোধ হয়। মনুষ্যলোকে যেসব প্রাণী আছে তারা সবাই নিজেদের ভোগ্যবস্তু মানুষের কল্যাণে ঢেলে দিয়েছে, আর মানুষ যুগযুগ ধরে তা ভোগ করে আসছে। ভোগের পরিমাণ বেশি হলে মন দস্যু হয়ে উঠে, না পেলেই মটকা গরম হয়ে যায়!
তাই শ্রেষ্ঠ পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন, ভোগ থেকে আসক্তি জন্মে, আসক্তি থেকে কামনার উদ্ভব, কামনায় যখন ব্যাঘাত ঘটে তখন ক্রোধের উৎপত্তি; ক্রোধ হইতে অবিবেক, অবিবেক হইতে স্মৃতিবিভ্রম, স্মৃতিবিভ্রম হইতে বিচার বুদ্ধিহীন, আর মানুষ যখন বিচারবুদ্ধিহীন হয়ে পড়ে তখন তার স্বয়ং বিধ্বংস ঘটে। মানুষের বিবেক নষ্ট হয়ে গেলে বুদ্ধির বিকার তো ঘটবেই।
মানুষ কেবলই চায়, সে যা পায় তা নিয়ে কখনও সন্তুষ্ট হতে পারে না।
আসলে মানুষ যা চায়, তা শরীরগত চাহিদা। দেহের চাহিদা যদি অন্তরের চাহিদার চেয়ে প্রবল হয়ে ওঠে তাহলে অন্তরের তলায় চর পড়ে যায়। দেহের চাহিদা যেখানে অত্যন্ত প্রবল অন্তরের চাহিদা সেখানে দুর্বল। মানুষের শরীরগত চাহিদা নিত্য পরিবর্তনশীল। পেটে ক্ষুধা পেলে ভাতের হাড়ির দিকে মন ঝুঁকে পড়ে, ক্ষুধা মিটে গেলে মন আবার অন্যকিছু খোঁজে। মনের ভাবনাটাই এই রকম বিক্ষিপ্ত। এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকাটা মনের স্বাভাবিক ধর্ম নয়। মন অত্যন্ত শক্তিশালী, বাতাসকে কোনো ঘরে আবদ্ধ করা আর মনকে নিজ নিয়ন্ত্রণে বেঁধে রাখা এ দুটো কথা সমান। মানুষ যা চায় তা যে একেবারে পায় না তা নয়। কিছু পায় কিছু পায় না, এই নিয়েই মানুষের যত দুঃখ-সুখ। দুঃখ-সুখের বাইরেও যে কিছু থাকতে পারে তা সে জানেই না।
চাঁদ এখন মেঘের ভিতর দিয়ে লুকোচুরি করছে। মনের ভাবনাটা অনাবিল, মনের ইচ্ছাতে মন চললে মন দস্যু হয়ে ওঠে। পাওয়া না পাওয়ার ভিতর দিয়েই সে তখন নিরন্তর ছুটে। বুদ্ধি যার পাকা মন তার স্থির, শান্ত, নিশ্চল।
বুদ্ধি তো আত্মার সহজ গুণ! আত্মাই কেবল সুন্দর; সেখানে জড়তা নেই। দেহ তো অপার্থিব, জড়। দেহ আত্মার মাধ্যমে নিজেকে প্রাণায়িত করে তোলে। আত্মাবিহীন দেহ মূল্যহীন। আর মানুষের যত চাওয়া দেহে, যা ক্ষণিক। আর ক্ষণিক বস্তু মাত্রই ধ্বংসশীল, সেখানে ভোগ আছে, সুখ আছে, লালসা আছে, আছে না পাওয়ার অর্থহীন যাতন।