ভক্তি মার্গ
ৎ বিকাশ বিশ্বাস
‘বিশ্বরূপ দর্শন যোগ’ শেষে যোগেশ্বর শ্রী কৃষ্ণ বলেছিলেন, অর্জুন! তুমি ভিন্ন কেউ দর্শন করেনি এবং কেউ দর্শন পাবেও না যেরূপ তুমি দেখলে; কিন্তু অনন্যভক্তি অথবা অনুরাগের সঙ্গে যিনি ভজনা করেন, তিনি আমার এইরূপ দর্শন করতে সক্ষম, তত্ত্বতঃ আমাকে জানতে পারেন এবং আমাকে স্থিতি লাভ করতে পারেন। অর্থাৎ পরমাত্মা এরূপ সত্তা, যাকে লাভ করা যায়। অতএব অর্জুন! তুমি ভক্ত হও। তাই ভক্তি যোগে অর্জুন শ্রী কৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভগবান! অনন্যভাবে যারা আপনার চিন্তা করেন এবং অন্যান্য যারা অক্ষর অব্যক্তের উপাসনা করেন, উভয়ের মধ্যে করা উত্তম? জবাবে শ্রী কৃষ্ণ বললেন, উভয়েই আমাকে লাভ করেন, কারণ আমি অব্যক্ত স্বরূপ; কিন্তু যিনি ইন্দ্রিয়সমূহকে বশীভূত করে বিক্ষিপ্ত মনকে সংযত করে অব্যক্ত পরমাত্মাতে আসক্ত, তাদের পথে কষ্ট বেশি হয়। যতক্ষণ দেহবোধ বিদ্যমান, ততক্ষণ অব্যক্তের প্রাপ্তি কষ্টকর; কারণ চিত্তের নিরোধ এবং বিলয়কালে অব্যক্ত স্বরূপ লাভ হয়। এই স্থিতির আগে সাধকের দেহই বাধক স্বরূপ। ‘আমি’, ‘আমি’, ‘আমাকে লাভ করতে হবে’Ñ বলতে বলতে নিজের দেহের দিকেই মনটা চলে যায়। তার বিচলিত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অতএব অর্জুন! তুমি সমস্ত কর্ম আমাকে সমর্পণ কর, অনন্য ভক্তি সহকারে আমার চিন্তা কর, মৎপরায়ন ভক্তগণ সমস্ত কর্ম আমাকে সমর্পণ করে, মানবদেহধারী স্বগুণ যোগীরূপ আমার ধ্যান করেন, আমি তাদের শীঘ্্রই সংসার থেকে উদ্ধার করি। অতএব ভক্তিমার্গ শ্রেষ্ঠ। অতএব অর্জুন! আমাতে মন সমাহিত কর। তা যদি না পার তাহলে সমাহিত করার অভ্যাস কর। মন বিক্ষিপ্ত হলেই পুনরায় আকর্ষণ করে তাকে নিরুদ্ধ কর। তাতেও অক্ষম হলে তুমি কর্ম কর। যদি তাও করতে অসমর্থ হও তবে পরমপিতা-পরমেশ্বরের শরণাগত হয়ে সমস্ত কর্মের ফল ত্যাগ কর, তাতে তুমি পরম শান্তি লাভ করবে।
এখানে যোগেশ্বর শ্রী কৃষ্ণ আরও বলেন, যিনি সমস্ত প্রাণীর প্রতি দ্বেষহীন, করুণাময় এবং দয়ালু, মমত্বশূন্য এবং নিরহংকার তিনি আমার প্রিয়ভক্ত। যার দ্বারা কোনো ব্যক্তি উদ্বিগ্ন হয় না এবং যিনি স্বয়ং কোনো ব্যক্তির দ্বারা উদ্বিগ্ন হন না, তিনিও আমার প্রিয় ভক্ত।
এছাড়া যিনি পবিত্র, সুখে ও দুঃখে নির্বিকার, যিনি আরম্ভের ত্যাগী ও মুক্ত, তিনিও আমার প্রিয়ভক্ত। সকল কামনা যিনি ত্যাগ করেছেন এবং যিনি শুভ-অশুভের উর্দ্ধেস্থিত, তিনি আমার প্রিয়ভক্ত। যিনি প্রশংসা ও নিন্দায় সম এবং মৌন, যার মন এবং ইন্দ্রিয়সমূহ শান্ত এবং মৌন, যিনি যেকোনো প্রকার দেহনির্বাহ সন্তুষ্ট এবং বাসস্থানের প্রতি মমত্ত্বশূন্য, দেহরক্ষাতেও যার আসক্তি নেই এইরূপ স্থিতপ্রজ্ঞ ভক্তিমান পুরুষ আমার প্রিয়ভক্ত। অবশেষে সকল কিছু নির্ণয় করে শ্রীকৃষ্ণ বললেন, অর্জুন! যিনি মৎপরায়ণ, অনন্য শ্রদ্ধার সঙ্গে উক্ত ধর্মময় অমৃতকে নিষ্কামভাবে উত্তমরূপে আচরণে পরিণত করেন তিনি আমার অত্যন্ত প্রিয়ভক্ত। অতএব সমর্পণের সঙ্গে এই কর্মে প্রবৃত্ত হওয়া শ্রেয়ষ্কর; কারণ তার লাভ-লোকসানের দায়িত্ব সেই ইষ্ট সদগুরু নিয়ে নেন। সর্বোপরি শ্রীকৃষ্ণ স্বরূপস্থ মহাপুরুষের লক্ষণ বললেন, তাদের আশ্রয়ে যেতে বললেন এবং নিজের শরণাগত হওয়ার প্রেরণা প্রদান করে সেই মহাপুরুষগণের সমকক্ষ নিজেকে ঘোষিত করলেন। আর এটাই ভক্তি মার্গের সারতত্ত্ব।
লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা