ট্রানজিটের কারণে আলোচনায় পানি কূটনীতি
শায়েখ হাসান : চলতি মাসেই ভারতের সঙ্গে নৌ ট্রানজিট আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। কলকাতা থেকে আরও একটি জাহাজ এই সপ্তাহেই বাংলাদেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। ট্রানজিট বিষয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতের তৎপরতা বেশি ছিল বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পানি কূটনীতিতে বাংলাদেশ বরাবরই ভারতের কাছে মার খেয়েছে। ট্রানজিটের কারণে আবারও সময় এসেছে অভিন্ন নদীগুলোর ঐতিহাসিক প্রবাহের সমাধান করার। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন পরবর্তী স্থিতিশীল অবস্থাও ফিরেছে। তাই অভিন্ন নদীগুলোর হিস্যা সমাধান করার প্রস্তাব এখন তুলতে পারে বাংলাদেশ। যেহেতু দ্বিপাক্ষিক একটি বড় ইস্যুতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ভারতের প্রস্তাব রেখেছে, তাই এই পেন্ডিং ইস্যু নিয়ে এখন আলোচনা করার মোক্ষম সময়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পানি কূটনীতির অভাবে অভিন্ন নদীগুলোর ঐতিহাসিক প্রবাহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। দেশের কৃষি, জনজীবন, জীব জীবন এবং অর্থনীতি বিপর্যস্ত হচ্ছে এর প্রভাবে। পানিশূন্য হয়ে উত্তরবঙ্গের ৫০টি নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে নদী অববাহিকা অঞ্চলের নদীনির্ভর জনগোষ্ঠী। আবাদী কৃষিজমি হয়ে পড়েছে মরুময়।
সমস্যা সমাধানে বিশেষজ্ঞরা মোটা দাগে সরকারের উদ্দেশ্যে চারটি আশু করণীয় সম্পর্কে বলেছেন। এগুলো হচ্ছেÑ পানি কূটনীতি নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান আরও পরিষ্কার করা, আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি ব্যবহারের জন্য সরকারের জোরালো ভূমিকা রাখা, অবিলম্বে জাতিসংঘ পানি প্রবাহ কনভেনশন ১৯৯৭ সনদে অনুস্বাক্ষর ও আলোচনার মাধ্যমে ভারতকেও তাতে অনুস্বাক্ষর করাতে রাজি করানো এবং একটি আঞ্চলিক সমন্বিত নদী ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
তারা বলছেন, পানি ভাগাভাগির চুক্তি নয়, ন্যায্যতা ও যৌক্তিকতার ভিত্তিতে পানি ব্যবহার করতে হবে। তিস্তা চুক্তি হলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পানি ভাগাভাগির চুক্তি হয় না, পানি ব্যবহারের চুক্তি হতে পারে। বাংলাদেশের উচিত এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে নিজেদের দাবি তুলে ধরা। তাহলে সমুদ্র বিজয়ের মতো আমরা সব নদীর ন্যায্য অংশও নিশ্চিত করতে পারব।
ধারণা করা হচ্ছে, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত ৫৭টি ছোট বড় আন্তর্জাতিক নদী রয়েছে। ভারত বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি নদীর মুখ ঘিরে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে এসব নদীর পানি প্রত্যাহার করে নেবে তারা। পাশাপাশি শুকনো মৌসুমে বন্ধ করে দেবে ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রবাহ। বাংলাদেশের ৭০ ভাগ পানির উৎসই এই ব্রহ্মপুত্র। তাই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের মানুষ বিপদে পড়বে।
ব্রহ্মপুত্র নদকে ঘিরে ১২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করছে ভারত। এতে ৩৩টি রিজার্ভার নির্মাণের প্রয়োজন হবে। এর মাধ্যমে ৫০ লাখ কিউসেক পানিপ্রবাহ থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া ব্রহ্মপুত্রের মুখে একাধিক ড্যাম ও ব্যারেজ নির্মাণেরও পরিকল্পনা করছে ভারত। যদিও এজন্য বাংলাদেশকে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রদানের আশ্বাস দিয়েছে দেশটি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের কনভেনশনটি আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানিপ্রবাহ ব্যবহারের একটি মানদ-। এতে অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন বা ব্যবহারের সার্বিক নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও এই সনদে অনুস্বাক্ষর করেনি।
বাংলাদেশ পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ইনামুল হক বলেন, সনদটি আইনে পরিণত হয়েছে। আইনটিতে ভাটি ও উজান সকল দেশের নদীর উপর অধিকার, পানির ন্যায্য হিস্যা, নদীর দখল-দূষণ-কাঠামো নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ, নদী উন্নয়ন, নদী নিয়ে অববাহিকার দেশগুলোর মধ্যকার বিবাদ মীমাংসাসহ সব নদী সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করেছে। এ কারণে ভারত-চীন-মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের অমীমাংসিত সব নদীভিত্তিক বিবাদ বা মতভেদ নিরসনে আইনটি বাংলাদেশের নদীর সংকট সমাধানে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়া।
তিনি বলেন, অবিলম্বে বাংলাদেশের উচিত এই সনদে অনুস্বাক্ষর করা। একই সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ভারতকেও তাতে অনুস্বাক্ষর করাতে রাজি করানো প্রয়োজন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, ট্রানজিট ইস্যুতে সরকারের সুচিন্তিত পরিকল্পনার পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতার কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু আমরা সেখানে মার খেয়েছি। তিনি বলেন, গত এক বছরে ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের অতিআগ্রহ মনোভাবও আমরা দেখেছি। কিন্তু পানির ন্যায্য হিস্যা বুঝে নেয়ার বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতায় কোথাও যেন ফাঁক আছে। অন্তত এখন এ বিষয়ে সরকারের একটু মনোযোগী হওয়ার সময় এসেছে।
সম্পাদনা : হাসিবুল ফারুক চৌধুরী