ব্রেক্সিট : রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ
মোহাম্মদ আলী বোখারী ষ টরন্টো থেকে
ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ‘ইইউ’ থেকে ব্রিটেনের এক্সিট বা প্রস্থানের ক্ষেত্রে রেফারেন্ডাম, যা সংক্ষেপে ‘ব্রেক্সিট’ হিসেবে অভিহিত, তা সফলকাম হয়েছে। ফলে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিগত লাগাতার ক্ষমতাহরণে রক্ষণশীল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হলেও ডেভিড ক্যামেরণকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। কেননা এই ‘ব্রেক্সিট’ তার নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি ছিল এবং সেজন্য তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার জোর প্রচারণা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। শুধু যে তিনি সেটির সপক্ষে থেকে নিষ্ফল হয়েছেন তাই নয়, বরং তার বিরোধী পক্ষ লেবার পার্টি দলগত আদর্শের ভিত্তিতে অনুরূপ প্রচারণা চালিয়েছে।
এই রেফারেন্ডামের বিপর্যয় কর্মজীবী জনবসতির নিউ ক্যাসেল থেকে প্রথম আশাতীতভাবে দেখা হয়। সেখানে প্রস্থানের বিপক্ষে অর্থাৎ ‘রিমেইন’ মাত্র ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ, অথচ পার্শ্ববর্তী সান্ডারল্যান্ডে প্রস্থান বা ‘এক্সিট’-এর পক্ষে ৬১ শতাংশ ভোট পড়ে। অনুরূপভাবে ওয়েলসে প্রথম চারটি ফলাফলের গড় ৫৪ শতাংশ ‘এক্সিট’-এর পক্ষে গেলেও উওর আয়ারল্যান্ডের প্রথম পাঁচটি অঞ্চলের ফলাফল এমনকি স্বল্প ভোটপ্রয়োগ সত্ত্বেও স্কটল্যান্ডে ‘রিমেইন’ বা ‘ইইউ’-তে থাকার পক্ষেই ভোট পড়ে। একইভাবে দূরবর্তী জিব্রাল্টায় ৯৪ শতাংশ থাকার পক্ষে পড়লেও শেষটায় ব্রিটেনের সামগ্রিক ফলাফল ‘এক্সিট’-এর পক্ষে গিয়ে দাঁড়ায়। তাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের ২৮ জাতির সম্মিলন থেকে ব্রিটেনের প্রস্থান সহসা ঘটার ক্ষেত্রে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।
এতে লন্ডন থেকে প্যারিস এবং প্যারিস থেকে টোকিও অবধি বিশ্ব বাণিজ্যের কর্ণধারেরা হতাশ হয়েছেন। একইভাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা বিনিময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত পর্যটন, বিজ্ঞাপনী প্রচারণা এবং গাড়ির ব্যবসাসহ ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ড ও স্টক মার্কেটে ধস নেমেছে। বলতে গেলে সামগ্রিক বিশ্ব অর্থব্যবস্থায় ঝাঁকুনির সঞ্চার হয়েছে। তিন দশকের মাঝে ব্রিটিশ পাউন্ড সর্বনিম্ন বিনিময় হারে গিয়ে ঠেকেছে। ২০০৮ সালের পর টোকিওর শেয়ারবাজার ৮ শতাংশ নিম্নমুখী হয়েছে। অপরাপর এশীয় বাজারেও একই প্রভাব দেখা দিয়েছে এবং তাতে মার্কিন ডলারের ১ দশমিক ৩৭০১ শতাংশ দরপতনের বিপরীতে ব্রিটিশ পাউন্ডের দরপতন ঘটেছে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। পাশাপাশি ইউরোর ১ দশমিক ২৩৫৫ শতাংশ দরপতনের বিপরীতে ব্রিটিশ পাউন্ডের অধঃগতি ঘটেছে ৪ শতাংশ।
আপাতদৃষ্টিতে ‘ব্রেক্সিট’-এর কারণে ব্রিটিশ মুদ্রার এই বিপর্যয় লক্ষণ প্রাথমিকভাবে ঘটলেও তার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। কেননা তাতে সংকুচিত ২৭ জাতির ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সূত্র বন্ধনগুলো ভিন্নতর হতে বাধ্য। তেমনটাই ফেসবুকে ধারণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও রাজনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ, যদিও পূর্বাহ্নে তিনি এই প্রস্থানের বিপক্ষে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন।
ড. আলী রীয়াজের ধারণা ও বিশ্বাস, এতে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সূচনা হল সেটি কোন পথে ধাবিত হবে তা বলা দুষ্কর। এই অনিশ্চয়তার প্রথম ধাক্কাটি অবশ্যই আমরা দেখব ব্রিটেনের অর্থনীতিতে। কিন্তু সেটা কেবল ব্রিটেনেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন যে, উত্তর আয়ারল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ডের মানুষ ইউনিয়নের পক্ষে থেকেছে, তারা কি নিজেদের পৃথকীকরণের দাবি তুলতে পারে না? তার মানে কি এই গণভোট ঐক্যবদ্ধ ব্রিটেনের অবসানের প্রথম পদক্ষেপ? এই গণভোটের প্রচারে এবং সম্ভবত বিজয়ের পেছনেও কাজ করেছে অভিবাসনের প্রশ্ন। এর অর্থ হচ্ছেÑ এখন ব্রিটেনে অভিবাসী বিরোধী মনোভাব চাঙ্গা হবে। এটির একটি সুস্পষ্ট বর্ণবাদী রূপ তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই আশঙ্কা সত্য হলে এর প্রথম শিকার হবেন অশ্বেতাঙ্গরা। অতীতে দক্ষিণ এশীয়রাই এই ধরনের আক্রমণের সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন,ব্রিটেনের এই ফলাফল যে ইউরোপের অন্য দেশের রাজনীতিতে পড়বে তা অনুমেয়। ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডের উগ্র জাতীয়তাবাদীরা তাকে পুঁজি করে ইউনিয়ন থেকে বেরুবার দাবি তুলবে। গত এক দশকে গোটা ইউরোপে উগ্র দক্ষিণপন্থী দলগুলো শক্তি সঞ্চয় করেছে। এই দলগুলো আরও শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করবে। এর প্রতিক্রিয়া কি আটলান্টিকের অপর পাড়ের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে পড়তে পারে? এরইমধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানে দেখতে পেয়েছি যার বক্তব্য ‘ব্রেক্সিট’-এর সমর্থকদের চেয়ে ভিন্নতর নয়। অভিবাসী বিরোধী মনোভাবকে শক্তিশালী করার চেষ্টা ট্রাম্পের প্রচারণার প্রধান দিক। ফলে এই আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না যে, তাতে তিনি শক্তিশালী হবেন। তবে এই প্রচেষ্টার সাফল্য নির্ভর করছে ডেমোক্রেটিক পার্টির উপরও। হিলারি ক্লিনটন এবং ডেমোক্রেটিক পার্টি যদি দেখাতে পারে এই ধরনের বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরিণতি ভালো নয়, তবে তার ফল উল্টোটাও হতে পারে।
তার এই দূরদর্শিতাপূর্ণ বক্তব্যের পাশাপাশি অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে ‘ব্রেক্সিট’-এর কারণে বাণিজ্য, অনুদান, লেনদেন ও পরিবহনসহ বহুবিধ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ব্রিটেনের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোয় স্বল্প উন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত অনুপ্রবেশ ছিল, তা এখন পুনর্নির্ধারিত হতে পারে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ব্রিটেন ছিল বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য গন্তব্য, যেখান থেকে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার আয় করা গেছে। যুক্তরাজ্যের উপাত্তে রয়েছে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি মালিকানাধীন ১০ হাজার কারি রেস্টুরেন্টে প্রায় ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান থেকে উপার্জনের পরিমাণ ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন পাউন্ড। লন্ডনের ডেইলি মেইল পত্রিকার ভাষ্য মতে, এই মালিকরা ‘ইইউ’ থেকে ব্রিটেনের প্রস্থানের পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছেন। এই মালিক সমিতির সভাপতি পাশা খন্দকারের মতে, ব্রিটেনের অভিবাসন নীতির কারণে প্রতিদিন ৫টি রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেনে ব্রিটিশ ব্যাংকের ‘রাউটিং’ ভূমিকা রয়েছে। একইভাবে বাংলাদেশি পণ্য পারাপারে ব্যবসায়ীরা ব্রিটেনকেই মধ্যবর্তী ‘হাব’ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাই ‘ব্রেক্সিট’-এর কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নে তা ভিন্নতর হতে বাধ্য। উপরন্তু ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্রিটেনে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যার ২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারই গার্মেন্ট রপ্তানি থেকে অর্জিত হয়েছে।
অনুরূপভাবে ‘ব্রেক্সিট’-এর কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পাদিত ‘কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক অ্যান্ড ট্রেড এগ্রিমেন্ট’ বা ‘সিটা’র অনেক সুবিধাই কানাডা বঞ্চিত হবে বলে কানাডার অর্থমন্ত্রী বিল মরনিও মিডিয়াকে জানিয়েছেন। পাশাপাশি ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর মার্ক কার্নির সতর্কতা মতে ব্রিটেন অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় পড়বে, আর তাতে ২০১৪ সালে ব্রিটেনে কানাডার বিনিয়োগকৃত ৬৯ বিলিয়ন ডলারই অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হবে। এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের চেয়ার জেনেট ইলেনের সতর্কতা সত্ত্বেও ‘ব্রেক্সিট’-এর কারণে নিম্নগামী পাউন্ডের বিপরীতে ঊর্ধ্বমুখী মার্কিন ডলার সামগ্রিক বাণিজ্য নিরুৎসাহিত করে তুলবে।
ই-মেইল : নঁশযধৎর.ঃড়ৎড়হঃড়@মসধরষ.পড়স