ধানমন্ডির পরিবেশই ছিনতাই উপযোগী!
রিকু আমির : পরিবেশগত কারণেই ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে রাজধানীর ধানমন্ডি। সরেজমিনে ঘটে যাওয়া বেশকিছু ছিনতাইয়ের ঘটনা বিশ্লেষণে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে। গত কয়েকদিন সরেজমিনে ধানমন্ডিতে ঘুরে দেখা গেছে, আবাসিক এ এলাকায় অসংখ্য রাস্তা রয়েছে, যেখানে দিনে দুপুরেই লোকজন চলাচল কম থাকে, আর রাতে সুনসান নীরবতা। সড়ক বাতিও থাকে না। যেসব জায়গায় সড়ক বাতি আছে, সেসব না থাকার মতোই।
ধানমন্ডি ২৭ নং এর বাসিন্দা আলমাস চৌধুরীসহ আরও কিছু এলাকাবাসীর মতে, মূলত: এ ধরনের পরিবেশকেই কাজে লাগাচ্ছে ছিনতাইকারীরা। এর সঙ্গে পুলিশও একমত। সর্বশেষ ২৩ জুন সন্ধ্যায় বিবিসি বাংলার প্রবাহ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক শারমিন রমা সন্ধ্যায় সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের কাছে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। সেসময় রিক্সায় সঙ্গে তার মেয়ে ছিল।
রমা ও পুলিশের ভাষ্যমতে, রিক্সার পাশে দুইজন মোটরসাইকেল আরোহী হঠাৎ করে তার হাতব্যাগ ধরে টান দেয়। এসময় তার হাতব্যাগের বেল্ট হাতের সাথে পেচানো থাকায় তিনি রিক্সা থেকে পড়ে যান। ধানমন্ডির সুলতানা কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্স থেকে ধানমন্ডি আট নম্বর ব্রিজ পর্যন্ত টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যায় মোটরসাইকেলটি। একটা পর্যায়ে তারা ব্যাগের বেল্টটা ছেড়ে দেয়, তখন রমা গড়িয়ে রাস্তার আরেক পাশে চলে যান। গত বৃহস্পতিবার রাতে সরেজমিনে ঘটনাস্থলে দেখা গেছে, এখানে চলাচল তুলনামূলক কম। অলিগলি আছে বেশকিছু। আলোর চেয়ে আঁধারের আধিপত্যই বেশি। সুলতানা কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্সের খুব কাছে জগলুল ইসলামের বাসা। তিনি বলেন, এ রাস্তায় ছিনতাই নতুন কোনো ঘটনা নয়। টহল পুলিশ মাঝে মধ্যে দেখি। কিন্তু কই, লাভ তো হচ্ছে না।
শুধু রমার ঘটনাই নয়, গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১১টার দিকে সাইকেলবাহী ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে ল্যাপটপ খোয়া যায় রিক্সা আরোহী সাংবাদিক ফাওজুল কবিরের। জানা যায়, রিক্সায় ধানমন্ডি ২৭ পার হয়ে ১৫ নম্বর ইবনে সিনা হাসপাতালের কাছে পৌঁছলে মোটরসাইকেল আরোহী দুই ছিনতাইকারী চলন্ত রিক্সা থেকে ল্যাপটপটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ধানমন্ডির এক নম্বর রোডের ৩৯ নম্বর বাসার সামনে ব্যবসায়ী মিরাজকে অস্ত্র ঠেকিয়ে এবং তার কর্মচারী হারুনকে কুপিয়ে দুই লাখ টাকা লুট করে ছিনতাইকারীরা।
২০১৫ সালের ২৫ মার্চ দুপুরে ধানমন্ডির ৫ নং রোডস্থ ঢাকা ব্যাংক থেকে দুই ব্যক্তি সাড়ে ১৬ লাখ টাকা তুলে অফিসে যাওয়ার পথে অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছিল ছিনতাইকারীরা। একই বছর ৭ জুন বিকালে ধানমন্ডির কলাবাগান মাঠ সংলগ্ন ঢাকা ব্যাংকের কাছ থেকে রেডিমেড পোশাক ব্যবসায়ী মো. শামীমের (২৬) কাছ থেকে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা।
২০১৪ সালের ৪ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে ধানমন্ডিতে চালক নুরুল ইসলামকে অজ্ঞান করে একটি সিএনজি চালিত অটোরিক্সা নিয়ে পালিয়ে গেছে অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা।
২০১২ সালের ৫ এপ্রিল বিকালে ধানমন্ডি থানার ৫ নম্বর রোডস্থ আইএফআইসি ব্যাংক থেকে তোলা ২০ লাখ টাকা কমান্ডো স্টাইলে ছিনিয়ে নিয়েছে ছিনতাইকারীরা। এনা প্রপার্টিজ লিমিটেডে ম্যানেজার আলমগীর হোসেন আইএফআইসি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে।
ধানমন্ডিতে ছিনতাইয়ের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ঘটে ২০১১ সালের অক্টোবরে। ২৮ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ধানমন্ডির সোবহানবাগ মসজিদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন আয়েশা আক্তার রিপা। ৩/৪ জন ছিনতাইকারী মাইক্রোবাস থেকে রিক্সাআরোহী রিপার ব্যাগ ধরে টান দেয়। ব্যাগের হাতল রিপার হতে আটকে থাকায় টান লেগে তিনি রিক্সা থেকে পড়ে যান। ওই অবস্থায় মাইক্রোবাসটি তাকে রাস্তায় হেঁচড়ে প্রায় ৫০০ গজ টেনে নিয়ে যায়। একপর্যায়ে ছিনতাইকারীরা ব্যাগটি পেয়ে চলে যায়। পথচারীরা রিপাকে উদ্ধার করে ধানমন্ডির বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় পুলিশ মো. আবুল কালাম, মো. হেমায়েত হোসেন ওরফে হিমু ও মো. আলমগীর হোসেন ওরফে রতনকে গ্রেফতার করেছিল।
২০১০ সালের ১০ জুলাই সকালে ব্যবসায়ী নুরুজ্জামানের কাছ থেকে জুনিয়র ল্যাবরেটরি স্কুলের সামনে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ৫ লাখ টাকাভর্তি ব্যাগ কেড়ে নিয়েছিল ছিনতাইকারীরা।
সরেজমিনে জানা যায়, ইবনে সিনা হাসপাতালের গলি হয়ে যে রাস্তাটি ধানমন্ডি লেক হয়ে কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে মিলেছে, সে রাস্তা সব সময়ই নীরব থাকে। রাস্তার সঙ্গে সংযোগ অলিগলিও রয়েছে অনেক। যার ফলে অপরাধ সংঘটিত করে পালানো কোনো ব্যাপার না।
একই অবস্থা ধানমন্ডি থানার ৫ নম্বর রোড, কলাবাগান মাঠের পেছনের অংশ, ৭ নম্বর, ৭/এ নম্বর, ৮ নম্বরসহ অন্তত ১৫টি সড়ক রয়েছে, যেখানে মানুষের চলাচল খুবই কম।
ধানমন্ডি থানার ওসি নূরে আজম মিয়া এ প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, ধানমন্ডিতে ছিনতাই আগের চেয়ে অনেক কমেছে। এক সময় যেখানে প্রতিদিন এক-দুটো ঘটনা ঘটতো, সেখানে এ বছর ঘটেছে মাত্র তিনটি।
তিনি বলেন, ছিনতাইরোধে পুলিশ সবসময়ই তৎপর। সমস্যা হয়, এ এলাকা অনেক নীরব, মানুষ চলাচল খুব কম, রাতে রাস্তায় আলোকস্বল্পতা রয়েছে, অলিগলিও প্রচুর। এছাড়া আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, মোটরসাইকেল নিয়ে যারা ছিনতাই করে তাদের ক্ষেত্রে, চেহারা কিংবা গাড়ি দেখে চেনা যায় না। ঘুরতে থাকে, নিরাপদ জায়গায় গিয়ে কারও না কারও উপর হামলে পড়ছে। তিনি সাধারণ মানুষকে সচেতন হবার আহ্বান জানিয়ে বলেন, রিক্সায় চলাচলের সময় নারীরা যেন ব্যাগ দুপায়ের মাঝে রাখেন, কারও বেশি পরিমাণ টাকা বহনের প্রয়োজন হলে যেন অবশ্যই পুলিশের সহযোগিতা গ্রহণ করে। কোথাও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলে প্রত্যক্ষদর্শীরা যেন এগিয়ে যান। মানুষের মধ্যে এমন সচেতনতা থাকলেই ছিনতাইয়ের ঘটনা আরও কমবে বলে মনে করেন ওসি নূরে আজম মিয়া।
থানার ওসি (তদন্ত) হেলাল উদ্দিন এ প্রতিবেদককে বলেন, ঈদের জন্য বিশেষ টহল তো আছেই। পাশাপাশি সারাবছরই ছিনতাইসহ অন্য অপরাধ প্রতিরোধে আমাদের তৎপরতা রয়েছে। সম্পাদনা : সৈয়দ নূর-ই-আলম