নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও পলাশীর যুদ্ধ
তানভীর আহমেদ
যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব ইংরেজদের ক্ষমা করে পুনরায় বাণিজ্য করার অনুমতি দিলে ইংরেজরা সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখা শুরু করে।
১৭৫৬ সালের ১৫ এপ্রিল নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলার মসনদে আসীন হন এবং তার পূর্ণ নাম ও পদবি হয় নবাব মনসুর-উল-মূলক মির্যা মোহাম্মদ শাহ্ কুলি খান সিরাজউদ্দৌলা হযরত জঙ বাহাদুর। সিংহাসনে আরোহণ করেই সিরাজ বুঝতে পারেন বাইরের শত্রুর আগে তাকে ঘরের শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এদের মধ্যে ছিলেন খালা ঘসেটি বেগম, খালা মোমেনা বেগমের পুত্র পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা শওকত জঙ ও আলীবর্দী খাঁর বৈমাত্রেয় বোনের স্বামী মীর জাফর আলী খান। এখানে উল্লেখ্য যে, আলীবর্দী খাঁ রাস্তা থেকে তুলে এনে মীর জাফরকে নিজের বোনের সঙ্গে বিয়ে দেন। তাছাড়া তাকে উড়িষ্যার নায়েবে নাযিম নিয়োগ করা হলে কাপুরুষতার কারণে তিনি সে দায়িত্বপালনে ব্যর্থ হন। এরপর তাকে সেনাবাহিনীর প্রধান বখশি ও প্রধান সেনাপতি পদে নিযুক্ত করা হয়। আলীবর্দী খাঁর জীবদ্দশায় মীর জাফর তার বিরুদ্ধে একাধিকবার বিদ্রোহ করে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। ফলে আলীবর্দী খাঁ তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন। কিন্তু পরে নবাব পরিবারের সদস্যগণের অনুরোধে তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করেন। এখানে লক্ষ্যণীয়, দূরদর্শী আলীবর্দী খাঁ আবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে যদি হোসেনকুলী খানের ন্যায় একই ব্যবস্থা মীর জাফরের বিরুদ্ধেও নিতেন তাহলে পরে বাংলার ইতিহাস পাল্টে যেত।
সিরাজউদ্দৌলা মসনদে বসেই প্রশাসনে কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসেন। মীর জাফরকে সেনাবাহিনীর প্রধান বখশির পদ থেকে সরিয়ে মীর মদনকে সেখানে নিয়োগ দেন। এছাড়া মোহনলালকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করা হয়। এরপর সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের কলকাতায় অবস্থিত কাসিমবাজার কুঠির ব্যাপারে মনোযোগী হন। কারণ সিরাজউদ্দৌলা তাদের এদেশে কেবল বণিক ছাড়া আর কিছু ভাবেননি। এ কারণে ১৭৫৬ সালে ২৯ মে কাসিমবাজার কুঠি অবরোধ করা হয়। ফলে ইংরেজরা নবাবের হাতে যুদ্ধাস্ত্র তুলে দিয়ে মুচলেকার মাধ্যমে এ যাত্রায় মুক্তি পায়। কলকাতার নাম বদল করে নবাব আলীবর্দী খাঁর নামানুসারে আলীনগর রাখা হয়। এরপরই সিরাজউদ্দৌলা তার খালাতো ভাই পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা শওকত জঙের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হন। কারণ মসনদ প্রত্যাশী শওকত জঙ কৌশলে তৎকালীন মুঘল সম্রাটের প্রধানমন্ত্রী মীর শিহাব-উদ-দীন উমাদ-উল-মূলকের নিকট হতে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সুবেদারির সনদ লাভ করে নিজেকে নবাব হিসেবে ঘোষণা দেন ও সিরাজউদ্দৌলাকে মসনদ ত্যাগে হুমকি প্রদান করতে থাকেন। ফলে সিরাজউদ্দৌলা তার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। এই অভিযানেই শওকত জঙের মৃত্যু ঘটে। এদিকে কলকাতার শাসনকর্তা মানিক চাঁদের বিশ্বাসঘাতকতায় ১৭৫৭ সালের ১ জানুয়ারি ইংরেজরা কলকাতা পুনরুদ্ধার করে। ফলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলাকে পুনরায় অভিযান পরিচালনা করতে হয়। কিন্তু এ অভিযান পুরোপুরি সফল হয়নি। সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ইংরেজদের সঙ্গে সন্ধি স্থাপনে বাধ্য হন যা আলীনগরের সন্ধি বলে খ্যাত। ইতোমধ্যে, ইংরেজরা নবাব পরিবারের অন্তর্দ্বন্দ্ব সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল হয়ে যায়। এ ষড়যন্ত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন জগৎশেঠ। উল্লেখ্য, এই জগৎশেঠের পরিবারই বিশ্বাসঘাতকতা করে নবাব সরফরাজ খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য আলীবর্দী খাঁকে সহায়তা করেছিল।
লেখক: সহকারী পরিচালক, কমিউনিকেশন্স এন্ড পাবলিকেশন্স বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক
সম্পাদনা: জব্বার হোসেন