মাঠপর্যায়ের জঙ্গিরা গ্রেফতার হলেও গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে
আজাদ হোসেন সুমন : মাঠপর্যারে জঙ্গিরা গ্রেফতার হলেও তাদের গডফাদাররা রয়ে গেছে পুলিশের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ফলে জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন করা যাচ্ছে না কিছুতেই। সম্প্রতি দেশব্যাপী পরিচালিত বিশেষ অভিযানে ১৯৪ জঙ্গি এবং গত এক বছরে পুলিশ ও র্যাবের হাতে শতাধিক জঙ্গি গ্রেফতার হলেও তাদের নেপথ্যে থাকা ‘মাস্টারমাইন্ডেড’ গডফাদারদের গ্রেফতার করতে পারছে না পুলিশ। ফলে পর্দার আড়ালে থেকে এসব গড ফাদার দেশব্যাপী নাশকতামূলক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি ঝিনাইদহে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান সমীর আলী এবং নলডাঙ্গা মন্দিরের পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন চার জঙ্গিকে এবং নাটোরের বনপাড়ায় খিস্টান দোকানি সুনীল গোমেজ হত্যাকা-ের শিকার হয়। এঘটনাগুলোতে সবুজ ও মনি নামের সন্দেহভাজন দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
গত বছরের ২১ এপ্রিল আশুলিয়ার কাঠগড়া বাজারে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে ডাকাতি ও আটজনকে হত্যার ঘটনায় নেতৃত্ব দেয় হোজ্জা ছাড়াও আসিফ আজওয়াদ নামের এক জঙ্গি। পুলিশ ওই ঘটনায় ১০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করলেও নেপথ্যের নায়কদের চিহ্নিত বা গেফতার করতে সক্ষম হয়নি। ৭ জুন ঢাকার পল্লবীতে সুলতান মাহমুদ ওরফে রানা ওরফে কামাল এবং ৮ জুন বগুড়ায় কাউছার আলী নামের দুই জেএমবি সদস্য ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। এছাড়াও জেএমবির আরও পাঁচ জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে গৌড়ীয় মঠের অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায়কে গলা কেটে হত্যার ঘটনায় ৭ জনকে ও ১২ নভেম্বর নীলফামারীর সৈয়দপুরে শিয়া সম্প্রদায়ের প্রতীকি কারবালার খাদেম হাসনাইনকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করার ঘটনায় ১১ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
পুলিশ কনস্টেবল মুকুল হোসেনকে গত বছরের ৪ নভেম্বর আশুলিয়া এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা। ওই হত্যাকা-ে অংশ নেয় জেএমবির সামরিক কমান্ডার মাহফুজ ওরফে হোজ্জা, হীরণ ও তারেক। গত ৩ এপ্রিল বগুড়ার শেরপুরে বিস্ফোরণে নিহত দুজনের একজন এই তারেক বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত ৭ জুন ঢাকার পল্লবীতে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তারেক ওরফে ওসমান নামে আরেক জেএমবি সদস্য নিহত হয়।
৮ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ব্যবসায়ী তরুণ দত্ত হত্যা এবং ২৬মে দেবেশ চন্দ্র প্রামাণিককে হত্যার ঘটনায় জেএমবির তিন জঙ্গিকে গেফতার করা হয়। ১০ জুন পাবনার হেমায়েতপুরে অনুকূল চন্দ্র সৎসঙ্গ আশ্রমের সেবায়েত নিত্যরঞ্জন পান্ডে হত্যার ঘটনায় এক শিবির নেতাসহ দুই সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করে।
অন্যদিকে গত বছরের ৫ অক্টোবর পাবনার ঈশ্বরদীতে খ্রিস্টান ধর্মযাজক লুক সরকারকে গলা কেটে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় ছয় জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ, যারা আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। গত বছরের ২৪ নভেম্বর ফরিদপুরে দুর্বৃত্তদের হামলায় আহত হন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা অলোক সেন আহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশ সাতজনকে গ্রেফতার করে।
রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটে নিজ কার্যালয়ে জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা এবং লালমাটিয়ায় প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢুকে এর কর্ণধার আহমেদুর রশিদ চৌধুরী টুটুল, কবি তারেক রহিম ও লেখক রণদীপম বসুকে কোপানো, গত ২৫ এপ্রিল কলাবাগানে বাসায় ঢুকে জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু তনয়কে হত্যায় আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের দুই সদস্য, একইভাবে সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় হত্যা, রাজধানীর গোড়ানে ব্লগার নীলাদ্রি চ্যাটার্জি নিলয় হত্যা, গুলশানে ইতালীয় নাগরিক তাভেল্লা সিজার হত্যা, রংপুরে জাপানী কুনিও হোশি হত্যা, কাউনিয়ায় মাজারের খাদেম রহমত উল্লাহ হত্যা, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে শিয়া সম্প্রদায়ের আবদুর রাজ্জাক হত্যা, রাজধানীর সূত্রাপুরে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমুদ্দিন সামাদ হত্যা, টাঙ্গাইলের গোপালপুরে দর্জি নিখিল চন্দ্র জোয়ারদার হত্যা, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ মং শৈ উ হত্যা এবং কুষ্টিয়ায় মীর সানোয়ার হোসেন হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন অর্ধশত জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু এদের নেপথ্য নায়ক বা মাস্টার মাইন্ডেড গডফাদাররা রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক আইজিপি মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী বলেন, অভিযানে চুনোপুটিরা ধরা পড়ে। গডফাদাররা ব্রেনওয়াশ করে নতুন নতুন মাঠপর্যায়ের জঙ্গি তৈরি করে। লাভ কি? জঙ্গিবাদ দমন বা মূলোৎপাটন করতে হলে গডফাদারদের গ্রেফতার করা একান্ত জরুরি। সুতরাং তদন্তকারী সংস্থাগুলোর উচিত পরিকল্পনাকারীদের গ্রেফতার করা যতদিন সেটা সম্ভব না হবে ততদিন পর্যন্ত পুলিশের এ মিশন সফল হবে না।
অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেসুর রহমান বলেন, জঙ্গিবাদ নির্মূলে পুলিশের চেষ্টা অব্যাহত আছে। পুলিশের অভিযানে গত এক বছরে ৫ শতাধিক জঙ্গি গ্রেফতার হয়েছে।
তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ নির্মূলে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। শুধু সরকারকে দোষারোপ করে নয়, জঙ্গিবাদ নির্মূলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকেও জঙ্গিদের প্রশ্রয় দেওয়া থেকে বিরত থেকে সরকারকে সহায়তা করতে হবে। এছাড়াও দেশ থেকে জঙ্গিদের মূলোৎপাটনে পুলিশকে সহায়তা করার জন্য সচেতন নাগরিক সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। সম্পাদনা : সৈয়দ নূর-ই-আলম