আমাদের কোনো প্রায়োগিক ক্ষমতা নেই
ড. মিজানুর রহমান
জাতীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। কমিশনের যে নীতিগত অবস্থান সেখান থেকে আমরা একটুও সরে আসিনি। অর্পিত দায়িত্বটি আমরা সঠিকভাবে পালন করছি বলেই মনে করি। শুরুর চেয়েও মানবাধিকার কমিশনের অবস্থান এখন অনেক দৃঢ়। সুসংসহত। যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন মানবাধিকার কমিশন অনেক বেশি শক্তিশালী। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে এখন কেউ অবহেলা বা তাচ্ছিল্য করার দুঃসাহস দেখায় না। সেই অবস্থানটা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি আমরা। তবে মুশকিল হচ্ছে, আমাদের কোনো নির্বাহী বা প্রয়োগিক ক্ষমতা নেই। ফলে যতকিছুই করি না কেন, সুপারিশ দিই না কেনÑ তা কোনো সংস্থার জন্য বাধ্যতামূলক বলে বিবেচিত হয় না। এটা আমাদের দুর্বলতা নয়Ñ যে আইন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছি আমরা, সেই আইনের দুর্বলতা। আইনের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য ইতোমধ্যে সরকারের কাছে সুপারিশও পাঠিয়েছি আমরা।
মানবাধিকার কমিশন নিরপেক্ষ একটি প্রতিষ্ঠান। নিরপেক্ষতা বজায় রেখেই কাজ করার চেষ্টা থাকে আমাদের। তবে নিজের অবস্থান বজায় রেখে চলাও অনেকসময় মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। কারণ আমাদের বক্তব্য অনেক সময় সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষেও যেতে পারে। যখন আমরা ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে কথা বলি, তখন বলতে পারেনÑ আমি কী বিরোধীদলের সুরে কথা বলছি? কারণ সেটা তাদের পক্ষে যাচ্ছে। তখন সরকার দলীয়রা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। নালিশ করেন। যখন জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিই, যখন আমার কোনো বক্তব্য সরকারের পক্ষে যায়, তখন বিরোধীদল বলে, উনি তো সরকারের চামচা। সরকারের চামচামি করে। যখন উভয় পক্ষ থেকেই আমাকে গালিগালাজ করা হয়, তখন আমি মনে করিÑ বোধ হয় আমি সঠিক পথেই আছি। উভয় পক্ষই আমার সমালোচনা করে, উভয় পক্ষের কাছেই আমি গ্রহণযোগ্য, আবার অগ্রহণযোগ্য। এই জায়গাটিই প্রমাণ করে আমি নিরপেক্ষ। অবশ্যই আমরা নিরপেক্ষ। নিরপেক্ষভাবেই আমরা কাজ করার চেষ্টা করি।
মানুষের অধিকার নিয়ে আমরা কাজ করছি। যতটা সম্ভব রাষ্ট্রকে তার ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। কোনোভাবেই যেন রাষ্ট্রের ভুল সিদ্ধান্তে একজন মানুষও হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়ে আমাদের তৎপরতা রয়েছে। মানবাধিকার পরিস্থিতি যেন দেশে সন্তোষজনক থাকে। কিন্তু অনেকসময় দেখা যায়, আমাদের সেই তৎপরতার ফল মিলে না। মানুষের মৌলিক অধিকারটি সংরক্ষিত হয় না। কলেজ শিক্ষক হত্যা চেষ্টার পরবর্তী পুলিশি কর্মকা- দেখুন, কলেজ শিক্ষককে কুপিয়ে হত্যা করতে গেলে এক জঙ্গিকে জনগণ হাতেনাতে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে। পুলিশ তাকে রিমান্ডেও নেয়। ভেবেছিলাম, এখন তার কাছ থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পাওয়া যাবে। এই তথ্যের মাধ্যমে কারা জঙ্গিবাদ, গুপ্তহত্যার সঙ্গে জড়িত, কারা এসব সমর্থন করছে, কারা পরিকল্পনা করছে, কে তাদের অর্থ যোগানদাতা, কারা ষড়যন্ত্রকারীÑ এসবের সূত্র ধরে জঙ্গিবাদের মূল হোতাদের বের করতে সক্ষম হবো। এসব নির্মূল করাও সম্ভব হবে। কিন্তু দেখা গেল, যার কাছ থেকে আমরা তথ্যগুলো সংগ্রহ করতে পারব, ‘বন্দুকযুদ্ধে’র মাধ্যমে তাকেই বিদায় করে দেওয়া হলো। ফলে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ক্ষেত্রে, অভিযানের ক্ষেত্রে সফলতার মুহূর্তে যখন আমরা উপনিত, সেইসময় বড় একটি ধাক্কা খেল এই অভিযান, এই মৃত্যুর ফলে। মানবাধিকারও সংরক্ষণ হলো না। এটা তো হয় না, হতে পারে না। কারণ এই দেশটি মানবাধিকার সংরক্ষণের ফসল। মানবাধিকার সংরক্ষণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সেই জায়গাটিতেই আমরা কাজ করছি। আশা করছি, কমিশন তার সমস্ত প্রচেষ্টা দিয়ে, আন্তরিকতা দিয়ে, সরকারের সহযোগিতা নিয়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবো। নিশ্চয়ই একদিন, মানুষের মৌলিক অধিকারের জায়গাটিও সুপ্রতিষ্ঠিত হবে বলেও আমি মনে করি।
সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে মতামতটি লিখেছেন আশিক রহমান
পরিচিতি : চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন