ক্ষমা করবেন, রণজিৎ দা
০১৭৩০৩২…। মোবাইল নম্বরটি আমার সেট থেকে ডিলিট করে দিয়েছি। কারণ নম্বরটি আর কখনও ব্যবহৃত হবে না। নম্বরটি ছিল একজন সাবেক সচিবের। তার নাম রণজিৎ বিশ্বাস। সর্বশেষ তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল প্রকাশকদের একটি অনুষ্ঠানে, শান্তিনগরে। তিনি তখন সংস্কৃতি সচিব থেকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত। তিনি অনুষ্ঠানে ঢোকার আগে কবি অসীম সাহা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে একহাত নিলেন, মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরলেন খেদের সঙ্গে। অসীমদার বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রণজিৎ বিশ্বাস ঢুকলেন। খাওয়া পর্বের আগে আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম। পিঠে হাত দিয়ে বললেন, ‘কালি ও কলমে তোমার একটা গল্প পড়েছি। তুমি লেখা বন্ধ করো না কিন্তু।’ আমি মাথা নাড়িয়ে হাসলাম, সায় দিলাম এবং মনে মনে ভাবলাম, আশ্চর্য, লোকটা লেখা বন্ধ না করার কথা বলছেন কেন! আমি কি তাকে বলেছি লেখা বন্ধ করে দেব?
তার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল সচিবালয়ে, তার দপ্তরে। তখন তিনি সমাজকল্যাণ সচিব। টইটুম্বুর পত্রিকার স্বত্বাধিকারী সাবিহ্-উল আলমের রেফারেন্সে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম একটা কাজে। আমি সচিবালয়ের গেটে দাঁড়িয়ে। পাস ছাড়া ভিতরে ঢোকা যাবে না। তাকে ফোন দিলাম। ফোন ধরলেন না। দ্বিতীয়বার রিসিভ করলেন। বললেন, ‘আমি তো জরুরি একটা মিটিংয়ে বাইরে, তুমি একটু অপেক্ষা কর। স্যরি।’ আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রায় আধঘণ্টা অপেক্ষার পর এক কাউন্টার থেকে আমার ডাক পড়ল। আমার পাস এসে গেছে। আমি সোজা তার রুমে চলে গেলাম। প্রথমে খুব ব্যস্ততা দেখালেন, কিন্তু পরে যখন জানলেন আমি টুকটাক লেখালেখি করি, সঙ্গে সঙ্গে নরম হয়ে গেলেন, সচিবসুলভ ভাবটা উবে গেল। শুরু হলো গল্প। ওদিকে আমার অফিসের ব্যস্ততা। বললাম, ‘আরেক দিন এসে আড্ডা দেব, আজ যাই।’ বললেন, ‘আরে বসো তো। আবার কখন আসবে ঠিক আছে!’ বললেন, ‘আমি তোমার লেখাজোখা পড়তে চাই। আমাকে একটা বই দিতে পারবে?’ আমি দেব বলে কথা দিলেও পরে বই দিলাম না। ভাবলাম, তিনি সচিব মানুষ, পড়াপড়ির এত সময় কই, না দেওয়াই ভালো।
বছরখানেক পর জাদুঘরে আবার দেখা। তিনি তখন সংস্কৃতি সচিব। অনুষ্ঠান শেষে যথারীতি তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। বললেন, ‘কই, তোমার বই তো দিলে না।’ আমি বললাম, ‘বই তো আমার কাছে নেই, প্রকাশকের কাছ থেকে সৌজন্যে পাওয়া সব কপি শেষ।’ তিনি বিব্রত হয়েছিলেন খানিক। বললেন, ‘আচ্ছা আমি সংগ্রহ করে নেব।’ জানি না তিনি সংগ্রহ করেছিলেন কিনা। কদিন আগে তিনি ফোন করলেন। অভিনন্দন জানালেন। আমি অফিসের কাজে খুব খুব এবং খুব ব্যস্ত ছিলাম বলে বেশি কথা বলতে পারলাম না। সবিনয়ে বললাম, ‘দাদা, আমি রাতে আপনাকে ফোন দেব।’ কিন্তু ফোন আর দেওয়া হয়নি।
একটু আগে শ্রদ্ধেয় কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার স্ট্যাটাসে দেখলাম, রণজিৎ বিশ্বাস সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘তার অনুপস্থিতি অপূরণীয়। তার প্রতি আমাদের অশেষ শ্রদ্ধা।’ বিডিনিউজের সাইটে ঢুকে দেখি খবর দেওয়া হয়েছে, ‘সাবেক সচিব রণজিৎ বিশ্বাস আর নেই।’ খবরটা পড়ে কেমন যেন লাগল। হায়, মৃত্যু আমাদের ঘাড়ের চেয়েও নিকটবর্তী! যেকোনো মুহূর্তে গলাটিপে ধরতে পারে! কেমন যেন অপরাধ বোধ হতে লাগল। একটা বই কি তাকে দেওয়া উচিত ছিল না? রাতের বেলায় আবার তাকে ফোন করা উচিত ছিল না? ক্ষমা করবেন রণজিৎ দা। আমি বিনীত ক্ষমা প্রার্থী। আপনার ভালোবাসাকে আমি যথাযথ সম্মান জানাতে পারিনি। বিদায়। আপনার জন্য হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন