নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও পলাশীর যুদ্ধ
তানভীর আহমেদ
ইংরেজরা জগৎশেঠের মাধ্যমে মীর জাফরকে মসনদে বসানোর চূড়ান্ত পরিকল্পনা করে ফেলে। পরিকল্পনায় আরও যোগ দেয় ঘসেটি বেগম, মীর জাফরের পুত্র মীরন, মীর জাফরের জামাতা মীর কাসিম, রাজা দুর্লভ রায়, উমিচাঁদ, রাজা রাজবল্লভ, মীর খোদা ইয়ার খান লতিফ প্রমুখ। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ১৭৫৭ সালের ৫ জুন মীর জাফরের একটি গোপন চুক্তি সম্পাদিত হয় যার ফসল ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। চুক্তি সম্পাদনের পরই রবার্ট ক্লাইভ পলাশীর প্রান্তরে সৈন্য সমাবেশ ঘটান। সিরাজউদ্দৌলাও তার সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। কিন্তু এ সময় মীর মদনের পরামর্শ উপেক্ষা করে মীর জাফরের কোরআন শরীফে হাত রেখে শপথের বিনিময়ে তাকে পূর্বপদে বহাল করেন। ইংরেজদের সঙ্গে গোপন চুক্তির বিষয়ে সিরাজউদ্দৌলা অবগত হলেও মীর জাফরের অনুগত সেনাদের সংখ্যা ও যুদ্ধাস্ত্রের পরিমাণ বিবেচনা করে তার বিরুদ্ধে তিনি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। এর ফলে সবচেয়ে মূল্যবান মুহূর্তে সিরাজউদ্দৌলা সাহসিকতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হন।
অবশেষে ঐতিহাসিক পলাশী যুদ্ধের ক্ষণ ঘনিয়ে আসে। রবার্ট ক্লাইভ ৩ হাজার সেনাসহ অগ্রসর হতে থাকেন। অন্যদিকে নবাব সিরাজউদ্দৌলা প্রায় ৫০ হাজার সেনাসহ অগ্রসর হন। কিন্তু সংঘর্ষের প্রথম পর্যায়েই বিশ্বস্ত সেনাপতি মীর মদনের মৃত্যু সিরাজউদ্দৌলাকে হতভম্ব করে দেয়। বারংবার অনুরোধ, অনুনয় ও শেষে নিজের পাগড়ি মীর জাফরের পায়ের নিকট সমর্পণ করেও সিরাজউদ্দৌলা মীর জাফরকে যুদ্ধে সক্রিয় করতে ব্যর্থ হন। ফলে বাধ্য হয়ে সিরাজউদ্দৌলা মীর জাফরের পরামর্শে যুদ্ধ স্থগিতের নির্দেশ দেন। যার কারণে ইংরেজদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টিকারী বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহনলাল যুদ্ধ শিবিরে ফিরে আসতে বাধ্য হন। এতে সিরাজউদ্দৌলার সেনাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সে সুযোগ ইংরেজ সেনারা গ্রহণ করে। এভাবে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ঘটে। সিরাজউদ্দৌলা কিছু বিশ্বস্ত অনুচর নিয়ে রাজধানীতে ফিরে যান। কিন্তু ২৯ জুন তাকে পলাতক অবস্থায় স্ত্রী ও কন্যাসহ আটক করা হয়। এরপর ৩ জুলাই মীর জাফরের পুত্র মীর সাদিক আলী খান মীরনের নির্দেশে মোহাম্মদী বেগ সিরাজউদ্দৌলকে হত্যা করেন। উল্লেখ্য যে, অনাথ মোহাম্মদী বেগ আলীবর্দী খাঁর স্ত্রী শরফ-উন-নিসার গৃহে লালিত পালিত হয়েছিলেন এবং প্রচুর ধনসম্পদ দান করে তিনি তাকে বিত্তশালী করেছিলেন।
সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যও অস্তমিত হয়। সিরাজের স্ত্রী লুৎফ-উন-নেসা ও তার একমাত্র কন্যা উম্মে যোহরা জাহাঙ্গীরনগরের জিঞ্জিরায় বন্দী জীবন শেষে আট বছর পর মুর্শিদাবাদে ফিরে যান। বহু অনুরোধের পর তিনি খোশবাগে অবস্থিত তার স্বামীর কবর তত্ত্বাবধানের সুযোগ পান। কিন্তু তিনি বেশিদিন বাঁচেননি। এর কিছুদিন পর তাকে তার স্বামীর কবরের পাশে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় এবং তাকে সেখানেই সমাহিত করা হয়। সিরাজের কন্যা উম্মে যোহরার সঙ্গে সিরাজের ভাই ইকরাম-উদ-দৌলার পুত্র মুরাদ-উদ-দৌলার বিয়ে হয় এবং তাদের চার কন্যা থেকেই সিরাজের বংশ প্রসারিত হতে থাকে। তবে সম্প্রতি ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় ইতিহাসের অধ্যাপক ড. অমলেন্দু দে তার ‘সিরাজের পুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, মোহনলালের বোন মাধবী ওরফে হীরা ওরফে আলেয়ার গর্ভে সিরাজের একটি পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। পলাশীর যুদ্ধের পর মোহনলাল সে পুত্রটিকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে ময়মনসিংহে আশ্রয় নেন। ময়মনসিংহের জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী পুত্রটিকে দত্তক গ্রহণের মাধ্যমে আশ্রয় দিতে সম্মতি জানান। পরবর্তীতে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর কনিষ্ঠ পুত্র কৃষ্ণগোপাল চৌধুরী পুত্রটিকে দত্তক নিয়ে নামকরণ করেন যুগলকিশোর রায় চৌধুরী। কিন্তু কৃষ্ণগোপাল দত্তক নেওয়ার সময় জানতেন না যে সে সিরাজের পুত্র।
পলাশীর যুদ্ধের বিশ্বাসঘাতকদের পরিণতি ছিল সিরাজউদ্দৌলার চেয়েও করুণ। মীর জাফরের মৃত্যু হয় দূরারোগ্য কুষ্ঠরোগে। সিরাজের হত্যাকারী মোহাম্মদী বেগের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে। এক পর্যায়ে সে কূপে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। মীরনকে ইংরেজরা হত্যা করে গুজব রটিয়ে দেয় যে মীরন বজ্রপাতে মারা গিয়েছে। ঘসেটি বেগমের মৃত্যু হয় নৌকাডুবিতে। জগৎশেঠকে গঙ্গা নদীতে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। রাজা দুর্লভ রায়ের মৃত্যু হয় কারাগারে ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে। উমিচাঁদের মৃত্যু হয় কারাগারে। পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা পরোক্ষভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উপনিবেশে পরিণত হয়। এরপর ক্রমশ পুরো ভারতবর্ষ বৃটিশদের শাসনাধীনে চলে যায়। মসনদলোভী কিছু ব্যক্তির জন্য পুরো ভারতবর্ষবাসীকে ১৯০ বৎসর বৃটিশদের অধীনে শাসিত হতে হয়। এজন্য পলাশীর যুদ্ধ পুরো ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
লেখক: সহকারী পরিচালক, কমিউনিকেশন্স এন্ড পাবলিকেশন্স বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক
সম্পাদনা: জব্বার হোসেন