নারী, প্রযুক্তি ও তোমার বন্ধু
বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখনও অনাদৃত। আমরা এখনও একটি মহাসত্যকে ভাবনায় নিতে প্রস্তুত নই যে সমাজের আটআনা সদস্যের পূর্ণ অবদান উন্নয়নসরণিতে যুক্ত করতে পারছি না। এর প্রধান কারণ, গুটিকয় উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছাড়া, নারীরা এখনও মানুষ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার আগে নারী হিসেবে বিবেচনায় আসেন। আমাদের ভাবনায় ও বিবেচনায় এখনও পরিষ্কার নয়, জনসংখ্যার গুরুত্বপূর্ণ অর্ধেক সমান পৃষ্ঠপোষণা থেকে বঞ্চিত হয়, এগিয়ে যাওয়ার গতি শ্লথ হয়ে যাবে। বিশেষ করে প্রযুক্তির উন্নয়নের যুগে প্রযুক্তিশিক্ষায় নারীর পশ্চাৎপদতা আমাদের অগ্রযাত্রার পথে বাঁধার সৃষ্টি করে।
আমরা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যদি চিন্তা করি তাহলে দেখব উন্নত বিশ্ব মেধা, শিক্ষা, উপযোগিতা, প্রযুক্তিজ্ঞান ও সকল প্রকার সক্ষমতার বিচারে নারীকে সমান ভাবা হয় না। নারীকে প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখার ফলে যা হয় তা হলো নারী বৈষম্যের শিকার হয়। তারা খুশি মনে সমাজ উন্নয়নে কাজ করতে পারে না। তাই প্রযুক্তির যুগে টেকনিক্যালি ও টেকনোজিক্যালি মজবুত করে গড়ে তুলতে হবে এবং কোথাও তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
যে দেশের সরকার প্রধান নারী, জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার নারী, তাছাড়া অনেক বিচারপতি ও বিচারক নারী, সরকারের সচিবও নারী, নারী বিমান ওড়াচ্ছে ও জাহাজ চালাচ্ছে, সে দেশে কখনোই ভাবা নয় যে নারীরা কোনো কাজের যোগ্য নয়। প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ও প্রযুক্তি দক্ষতা উন্নয়ন প্রগতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করবে। প্রকৃতিগতভাবে নারী ধীরস্থির ও মনোযোগী। তাদের মধ্যে শিক্ষার সঙ্গে আগ্রহ ও শ্রমশীলতা নিবিড়ভাবে যুক্ত। এটা আমরা বুঝতে পারি প্রযুক্তিনির্ভর গার্মেন্টস শিল্পের কথা থেকে। যে শিল্প আমাদের সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় সে শিল্পের সিংহভাগই এখন নারী।
নারীরা প্রযুক্তিগত দিক থেকে প্রশিক্ষিত হয়ে, দাপ্তরিক অনেক কাজ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করতে পারবে। নারীরা এখন কৃষিবিদ এবং যন্ত্রকৌশলের কাজে নিয়োজিত। এই কাজের সঙ্গে যদি প্রযুক্তির সমন্বয় করা যায় তাহলে অনেক বেশি সুফল আসবে। নারীর ধীশক্তি ও মেধাকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে দেশকে উন্নয়নের এগিয়ে নিতে নারীকে প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। তবেই দেশ পারবে বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে।
একসময় সে নারী কিন্তু পুরুষের সমপর্যায়ে এসে শহরমুখী হলো। কারণ মূলত তিনটি। এক, চাষের জমিতে টান পড়ল। দুই, কৃষিজীবীদের উৎপাদিত পণ্য অলাভজনক হয়ে পড়ল। তিন, জনস্ফীতির কারণে কৃষিজমি বসতভিটাতে পরিণত হওয়া। শহরে আসার পর তাদের নতুন জীবনে আর নানা সমস্যা প্রকট হতে থাকল। জীবন উদ্যাপন দূরে থাক জীবন যাপনই হয়ে গেল বড় সমস্যা। সে সময় তারা জীবনযাপনের জন্য নগদপ্রাপ্তির উৎস হিসেবে খুঁজে পেল পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানের চাকরি। যারা তাদের চাকরি দিল তারা যে খুব বদান্যতার অবতার সেজে তা করেছে তা নয়।
অনেক ক্ষেত্রেই তারা তা করেছে বেনিয়াবুদ্ধি থেকে এবং নিজেদের প্রয়োজনে। কোথাও কোথাও তারা শ্রমিকদের, বিশেষত নারী শ্রমিকদের কৌশলে বঞ্চিত করেছে। তারা আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা, আইএলও এর অবশ্য পালনীয় বিধানও অমান্য করেছে। তারপরও নারী শ্রমিকরা ক্রমবর্ধিষ্ণু হারে তৈরি পোশাকের শ্রমবাজারে যুক্ত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িবাড়ি গ্রহকর্ম সহায়ক হওয়ার চেয়ে এই পেশাকে বেশি গ্রহণযোগ্য ভেবেছে। তাই এ পেশাতে যা পেয়েছে বা পাচ্ছে সেটাকেই অনেক বেশি প্রাপ্তি বিবেচনা করেছে।
আজকে সারাবিশ্বে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটা বিশিষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য নাম, তার পেছনে আছে আমাদের নারীরা। এই কর্মীবাহিনী এখন অনেক বেশি সংগঠিত। তারা তাদের বাধ্যতাকে এখন শৃঙ্খলায় পরিণত করেছে। নিজেদের কাজে এবং প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতায় যেমন অবদান রাখছে তেমনি, আত্মোন্নয়নের জন্যও দেনদরবার করতে পারছে। কারণ তাদের পক্ষে এখন দরকষাকষি করার লোক আছে। তাদের মধ্যে সিবিএ আছে। তারা এখন ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারে।
এই সূচকগুলো বলে দেয়, গার্মেন্টস শিল্পের উন্নয়ন ও অগ্রগমণে নারীরা যে অবদান রাখছে তা অনেক বেশি সংগঠিত। এর ফলে উৎপাদনেও তারা অবদান রাখতে পারছে। এর প্রত্যক্ষ ফল হচ্ছে, দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও অর্থনীতিতে অবদান। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের মোটামুটি পঁচাত্তর শতাংশ পোশাকশিল্প থেকে আসছে। পোশাকশিল্পে নিয়োজিত নারীরা আমাদের ভাবনে ও অনুধাবনে স্বচ্ছ করে দিয়েছে যে তাদের উন্নয়নের ও কল্যাণের উদ্যোগ গ্রহণ এখন আর অনুগ্রহ বিতরণ নয় বরং
এটি এখন এক সুচিন্তিত বিনিয়োগ।
লেখক : কলামিস্ট ও শিক্ষক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন