জনগণ কী জানে? জানে শুধু রাজনীতিবিদ আর আঁতেলরা
যায়নুদ্দিন সানী
যেদিকে তাকাই, শুধু ব্রেক্সিট। হেন পত্রিকা নাই, যারা এনিয়ে রিপোর্ট করেনি। বিভিন্ন জাতের পরিসংখ্যান আর তথ্য, ওলটপালট করে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যতভাবে খবর করা সম্ভব। পড়তে পড়তে মোটামুটি নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। সবাই প্রায় একমত, মহা ভুল করল ব্রিটেন। এবার কী কী হবে, তার ফিরিস্তি পড়ছিলাম। স্কটল্যান্ড আলাদা হল বলে, আয়ারল্যান্ড ইউকে ছেড়ে মূল আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে যোগ দিল বলে, আর ইংল্যান্ড একঘরে হলো বলে।
বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের বক্তব্য শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, কাহিনী কোথায়? এই বিশেষজ্ঞরাই
কিছুদিন আগে বলছিল, ‘রিমেইন’ জিতবে। আজকে এক অনুষ্ঠানে এক বিশেষজ্ঞ একথাটা বলছিলেন, বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ যে বলেছিলেন, ‘রিমেইন’ জিতবে, তাদের দেশ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। এদের বিদ্যার দৌড় লন্ডন পর্যন্তই সীমিত। লন্ডনের বাইরেও যে একটা দেশ আছে, তাদেরও যে চাওয়া পাওয়া আছে, এ ব্যাপারটা সবাই ভুলে গিয়েছিল। কেন? কারণ, এসি রুম থেকে বেরিয়ে, ওদের কাছে যাওয়ার সময় এবং ইচ্ছা কারোরই নেই।
ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল পশ্চিমবঙ্গ ইলেকশানের সময়। তাবৎ আঁতেল সম্প্রদায় ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, মমতা যাচ্ছেন। বাম ভোট আর কংগ্রেস ভোট যোগ করে হিসাব মিলিয়ে দিয়েছিলেন। টাটা, বিড়লাসহ সব উদ্যোক্তা হা করে তাকিয়েছিলেন, বাম বিজয়ের জন্য। কিন্তু হলো না, কেন? ঐ যে বললাম, কলকাতার বাইরে কী হচ্ছে, তা সম্পর্কে জানেনই না এসব আঁতেল বাহিনী। প্রত্যন্ত অঞ্চল কী ভাবছে, তা নিয়ে রিপোর্ট করা, তা জানতে চাওয়া নিয়ে কারোরই তেমন মাথাব্যথা নেই। পুরো সাংবাদিকতা এ রোগে আক্রান্ত। আর আমরা কলামিস্টরা? কানা কে কানা না বলাই ভালো। আপাতত বাজারে চলছে ‘ভীতি’। ‘কী হবে ব্রিটেনের?’ অন্য ভীতি অতটা না হলেও আছে, ‘কী হবে ইইউর?’ একটা খবর দেখলাম, ব্রিটেনে এখন অনেকে গুগল করে খোঁজ নিচ্ছে, ‘ইইউ’ কী? অর্থাৎ যারা ভোট দিয়েছেন, তাদের অনেকেই জানেন না, ‘ইইউ’ কী? দোষ হোক, গুণ হোক, ইহাই গণতন্ত্র। ভোট দিতে বলছেন, দিছি। আর যারা প্রচার করতে এসেছিলেন, তারা যা বলেছেন, তাদের কথা শুনে ভোট দিছি।
কিছু কিছু লেখা পড়লাম, ‘গণভোট’ দেওয়া জরুরি ছিল না’Ñ এ বিষয়ে। কেউ বলছেন, কট্টরপন্থি ডানদের চাপে এ গণভোট দিয়েছিলেন ক্যামেরন, কেউ বলছেন বেশি প-িতি করে ধরা খেয়েছে ক্যামেরন। কেউ বলছেন, এমন এক টেকনিক্যাল ব্যাপারে গণভোট দেওয়াই উচিত হয়নি। কেউ কেউ বলছেন, লেবার পার্টি দায়সারা গোছের ক্যাম্পেইন করেছে, আরেকটু জোর দেওয়া উচিত ছিল। যত প-িত, তত মত। ক্যামেরন, পদত্যাগ সেরে ফেলেছেন। করবিন কী করবেন, বোঝা যাচ্ছে না।
এখন সব চোখ আটকে আছে, ‘ইইউ’ কী করে, তার দিকে। একধরনের বক্তব্য পেলাম, তা হচ্ছে, ‘ইইউ’ ছেড়ে কথা বলবে না। ব্রিটেনের সঙ্গে চুক্তি যদি করতেই হয়, এমন একটা করবে, যেন আর কোনো ‘ইইউ’ মেম্বার সাহস না করে, এভাবে বেরিয়ে যাওয়ার। খুব সহজে যদি ব্রিটেনকে ছেড়ে দেয়, অন্য অসন্তুষ্ট দেশগুলো তখন ভাবতে পারে, আমরাও একটা ট্রাই করি। উল্টোটাও আছে, বেশি টাইট দিতে গেলে ‘ইইউ’র জন্যও সমস্যা। ‘ইইউ’ এমনিতেই ‘সুপার স্টেট’ তকমার সঙ্গে লড়ছে। চালাচ্ছে কিছু টেকনোক্র্যাট। সো, ‘ইইউ’র জন্য সবাই যা ভাবছেন, ‘তেমন কোনো সমস্যা হবে না’ ব্যাপারটা এত সহজ না। অনেক কিছু নিয়েই তাদের ভাবতে হবে, ছাড় দিতে হবে। ‘অস্টারিটি মেজার’ নিয়ে কতটা কট্টর অবস্থান নেবে, মাইগ্রেশান ইস্যু কতটা ক্রোধের জন্ম দিচ্ছেÑ এসব নিয়েও আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। অন্যদিকে রয়েছে আর্থিক ব্যাপার, বিশেষ করে ‘ইউরো’ এখন ওদের গলার ফাঁস হয়ে আছে। গ্রিস বেরিয়ে যাবে যাবে করেও শেষ পর্যন্ত যায়নি। নেদারল্যান্ড, ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
কিন্তু একটা ব্যাপার ভেবে দেখেছেন, কেউই কিন্তু জনগণের কথা ভাবছে না। ব্রিটেনের জনগণ কেন এ সিদ্ধান্ত নিল, কী তাদের ভয়, কী তাদের চাওয়া, তা নিয়ে আলাপ খুব কম হচ্ছে। আলাপ সেই ঘুরেফিরে, পাউন্ডের পতন আর স্টক মার্কেটের ক্র্যাশ। ব্রিটেনের গ্রামাঞ্চল ‘লিভ’-এ ভোট দিয়েছে আর শহর অঞ্চল আর লন্ডন ‘রিমেইন’-এ। শহুরে জনগণ আর যুবকরা থাকতে চাইছে আর গ্রামাঞ্চলের মানুষ আর বৃদ্ধরা চাইছেন বেরোতে। কেন? গ্রামে কাজ নেই। সস্তা শ্রমের লোভে সব ‘ম্যানুফ্যাকচারিং’ কাজগুলো চলে গেছে চীনে। সেসব নিয়ে কেউই ভাবছে না, সবাই ভাবছে, আমাদের লাভ তো বেশি হচ্ছে। ‘ইইউ’ যে ‘অস্টারিটি’ প্ল্যান দিচ্ছে, তাতে ঝামেলায় পড়বে বৃদ্ধ আর পেনশানভোগীরা। তাই তারা ‘লিভ’-এ ভোট দিয়েছেন। একটু বাঁচার আশা। এই বৃদ্ধ বয়সে সরকার থেকে পাওয়া সুবিধা হারাতে চান না। ব্রিটেন সঠিক সিদ্ধান্ত নিল না ভুল, তা নিয়ে আলাপ করছি না। আলাপ করছি, আমাদের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আর আঁতেল বাহিনী যে দেশের মানুষের পালসই বোঝে না, তা নিয়ে। আমি যে কাজটা করছি, তা ঠিক না ভুল, তা নিয়ে রাজনীতিকরা কিংবা আঁতেলরা শুধু পরিসংখ্যান দেখছেন। জিডিপি বাড়ল কি না, ইনভেস্টমেন্ট বাড়ল কি নাÑ এসব নিয়েই সবাই ব্যস্ত। গ্রামের মানুষ কীভাবে আছে, তার চলছে কীভাবে তা নিয়ে ভাবার কেউই নেই। এদেশে? একই অবস্থা। টক শো দেখেন? কোনোদিন দেখেছেন, ধানের দাম নিয়ে তর্ক হচ্ছে? কৃষকের করুণ অবস্থা নিয়ে তর্ক হচ্ছে? আশা করেন, এমনটা হবে?
ব্রিটেন, যে শিক্ষাটা রাজনীতিবিদদের দিল, তা থেকে কি তারা কোনো শিক্ষা নেবেন? মনে হয় না। বরিস জনসনের দরকার প্রধানমন্ত্রীর গদি আর ইউকে ইন্ডেপেন্ডেন্স পার্টির দরকার জনপ্রিয়তা। দুটোই পেয়ে গেছেন। নাইজেল ফারাজ সাহেব এখন আরও গরম গরম কথা বলবেন। ইমিগ্রেন্ট খেদাও, সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। এক সময় হিটলার সাহেব ‘ইহুদি খেদাও’ বলেছিলেন। পাবলিক সেটা তখনও খেয়েছিল, এখনও খাবে। এবং যথারীতি তার জনপ্রিয়তা বাড়বে। জনসন সাহেব ইতোমধ্যেই সুর পাল্টাতে শুরু করেছেন, ‘আমরা ইইউ’ থেকে বেরিয়ে যাইনি। আমরা ইউরোপের অংশ’। এরপর ক্ষমতায় যদি আসেন, তখন? তখন কী হবে, দেখার জন্য সামনে রয়েছেন মোদি সাহেব। ‘আচ্ছে দিন আয়েঙ্গে’ বা ‘ভালো দিন আসবে’Ñ এমন স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। এরপর? অবস্থা তথৈবচ। মোদি সাহেব দুনিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর রকস্টার টাইপ পারফরমেন্স দিয়ে বেড়াচ্ছেন। ‘সময় লাগবে কিছুদিন’ বলে বছর দুয়েক চলল। ইতোমধ্যে কৃষক আত্মহত্যা চলছেই। বেকারত্ব কমার নাম নাই। যখন পাবলিক অতিষ্ঠ হয়ে উঠে তখন মাঝে মাঝেই ‘গরু’ আর ‘বাংলাদেশি উদ্বাস্তু’ নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করে দেন। ‘উদ্ভট’ সব ইস্যুর আমদানি করেন। ‘আসামে সব সমস্যার মূলে বাংলাদেশ থেকে আগত মুসলমান’Ñ এ সেøাগান নিয়ে রাজনীতি করে আসামে গদিতে চলে এসেছে বিজেপি। এটাই রাজনীতি। পাবলিককে ভুলিয়ে রাখো। সামনে আসছে, উত্তর প্রদেশ ইলেকশান। যথারীতি তখন মাথায় আসবে, ‘বাবরি মসজিদ’ বিতর্ক। আর তখন বাড়বে হিন্দু-মুসলমান টেনশান। দাঙ্গা লাগলে তো পোয়াবারো। না লাগলেও কিছু লাশ তো অবশ্যই পড়বে।
এত কথা কেন বলছি? কেউ কি শুনছে? মনে হয় না। তার চেয়ে বরং একটা জোকস বলি।
একদিন ক্লাসে শিক্ষক তার সোনার আংটিটা একটা গ্লাসের পানিতে ডুবিয়ে ছাত্রকে প্রশ্ন করলেন।
শিক্ষক : বল তো, এই আংটিটাতে মরিচা ধরবে কি না?
ছাত্র : ধরবে না স্যার।
শিক্ষক : গুড, ভেরি গুড। আচ্ছা বলতো, কেন ধরবে না?
ছাত্র : স্যার, আপনি জ্ঞানী লোক। যদি পানিতে রাখলে মরিচা ধরতো, আপনি কখনই আপনার সোনার আংটি পানিতে রাখতেন না।
কাহিনী এটাই, দেশ কীভাবে চলবে, আমাদের সমস্যার কোনো সমাধান হবে কি না, আমাদের ভাবার দরকার নাই। রাজনীতিবিদরা জ্ঞানী মানুষ, আমাদের ক্ষতি হয় এমন কাজ তারা করবেন না, এই ভরসা নিয়েই চলতে হবে। কারণ এই আঁতেল আর রাজনীতিবিদরা যেহেতু বলছে, আপনার কোনো সমস্যা নেই, আপনার নেই। আপনি কষ্টে থাকলেও ভাবতে পারবেন না, আপনি কষ্টে আছেন।