ভারত পারলে বাংলাদেশ পারবে না কেন?
আনু মুহাম্মদ
রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সুন্দরবনের বিনাশ যে ঘটবেই, তা দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত হওয়ার কারণেই এর বিরুদ্ধে শুধু দেশে নয়, সারাবিশ্বেই প্রতিবাদ, ক্ষোভ বাড়ছে। ইউনেসকো এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে সতর্কীকরণ জানাচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরেই। ভারতেও এর বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশ শুরু হয়েছে। কারণ সুন্দরবন শুধু বাংলাদেশের সম্পদ নয়, ভারতের মানুষও এর ভাগীদার, এটি বিশ্বের ঐতিহ্য। সুতরাং এর বিনাশ ঘটলে বাংলাদেশের মানুষ পড়বে বিপদে, দুর্যোগে অসম্ভব শক্তিশালী এক আশ্রয়, অরক্ষিত হয়ে পড়বে বাংলাদেশ। আর বিশ্ব হারাবে এক অমূল্য সম্পদ।
প্রথম থেকেই অনিয়মে ভরা এই দেশধ্বংসী প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ সরকার অনেক রকম ছাড়ও দিচ্ছে। ২০১৩ সালের ১ জুলাই ঘোষিত বাংলাদেশ সরকারের এসআরও অনুযায়ী কোম্পানি ১৫ বছরের জন্য আয়কর মওকুফ পাবে, এখানে কর্মরত বিদেশি ব্যক্তিদের আয়কর দিতে হবে না কমপক্ষে তিন বছর, বৈদেশিক ঋণের সুদের ওপর কর প্রযোজ্য হবে না, প্রকল্প নির্মাণে নির্বাচিত ভারতীয় হেভি ইলেকট্রিক কোম্পানির যন্ত্রপাতি আমদানিতেও কোনো শুল্ক দিতে হবে না। বাঁশখালীতেও কোনো নিয়মকানুন নেই, পরিবেশ সমীক্ষা নেই, খুন করেও শেষ হয়নি, মানুষের ওপর জোরজুলুম চলছে। রূপপুরে ৯০ হাজার কোটি টাকার বিরাট ঋণের বোঝা নিয়ে এক ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনছে সরকার। নিরাপদ বিদ্যুতের জন্য বিশাল গ্যাসসম্পদের আঁধার আছে বঙ্গোপসাগরে। বিদেশি কোম্পানির কাছে সেই গ্যাসসম্পদ হারানোর চুক্তি করার জন্য নানামুখী চেষ্টা চলছে। শতভাগ গ্যাস নিজেদের কাজে লাগানোর, পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির অসীম সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান ও জনবল তৈরির জন্য বরাদ্দ নেই।
২০০৬ সালে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভারতের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল শ্রীলঙ্কার। কয়েক দিন আগে মানুষ ও প্রকৃতির ওপর এর ফলাফল বিবেচনা করে এবং মানুষের দাবির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে শ্রীলঙ্কার সরকার এই প্রকল্প বাতিল করেছে। শ্রীলঙ্কা পারলে বাংলাদেশ পারবে না কেন? বাংলাদেশের সুন্দরবন তো আরও বড় কারণ এরকম প্রকল্প বাতিল করায়। শুধু তাই নয়, ভারতের জ্বালানি মন্ত্রণালয় ছত্রিশগড়, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র এবং ওডিশায় চারটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প একই ধরনের কারণে বাতিল করেছে। পাশাপাশি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সৌরবিদ্যুৎসহ ১৬ হাজার মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে।
ভারত পারলে বাংলাদেশ পারবে না কেন? আমরা বারবার বলি, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনের বহু বিকল্প আছে, কিন্তু সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই’, ‘যা দেশকে বিপন্ন করে তা উন্নয়ন নয়’, ‘দেশধ্বংসী রামপাল, রূপপুর, বাঁশখালী প্রকল্প নয়, বিদ্যুৎসঙ্কট সমাধানে জাতীয় কমিটির ৭ দফা বাস্তবায়ন করতে হবে।’ কিন্তু না, বাংলাদেশ সরকারের ইচ্ছা অতুলনীয় সম্পদ, চার কোটি মানুষের রক্ষা বাঁধ সুন্দরবন ধ্বংস করে ‘উন্নয়নের’ এক অভূতপূর্ব বিষাক্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেই হবে। বাজেটে এসব সাগরচুরি আর বনবিনাশী তৎপরতার সমর্থনে বরাদ্দ আছে, ছাড় আছে। নীতি নেই, বরাদ্দ নেই টেকসই বিদ্যুৎ সমাধানে জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের। ভুল নীতি আর দুর্নীতি তাই তৈরি করছে সাগরচুরি, নদী আর বনবিনাশের ‘উন্নয়ন’পথ।
লেখক : অর্থনীতিবিদ
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন