উত্তেজনায় বদলে যাওয়া জাতি, রাশ টানুন!
অজয় দাশগুপ্ত
সবসময় উত্তেজনার ভিতর থাকতে থাকতে মানুষ স্বাভাবিকতা ভুলে যায়। তার কাছে তখন সেটাই হয়ে ওঠে জীবনবোধ। বিভিন্ন দেশের বাচ্চা বা কিশোর কিশোরীদের দিকে তাকালেও তা বোঝা যাবে। সিরিয়ার বাচ্চারা আলবৎ মনে করে, পিস্তল বা গুলি গুলি খেলাটাই জীবন। মেসপটেমিয়ার সভ্যদেশ ইরাকে হয়তো তারা খেলে ট্যাংক বা কামান কামান খেলা। মনে আছে, একাত্তরে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার আগে বনবাসের মতো লুকিয়ে থাকার একটা ত্রৈমাসিক জীবন ছিল। গ্রামের সে জীবনে গাছের গুঁড়ির রাইফেল আর পাতার গুলি বানিয়ে আমরা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতাম। আপনি ইউরোপ, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার বালক-বালিকাদের দেখবেন, তারা জীবন নিয়ে খেলছে। তারা বলে ‘ফান’ করছি। আগে ভাবতাম, এত ফানের কি আছে? এসব কেমন কথা? এখন মনে হয়, ঠিক বলছে। যাদের জীবন রাষ্ট্রের কাছে গচ্ছিত, যারা বড় হয়ে কি হতে চায় তা নিজেরা পছন্দমতো ঠিক করতে পারে, যাদের ভাবনায় খুন, মারামারি বা হত্যার বিভীষিকা হঠাৎ থাকলেও লাগাতার না, তারা জীবনযুদ্ধকে ফান বা মজা বলতেই পারে।
এবার ভাবুন আমাদের দেশের কথা। রাজনীতির নামে বিগত কয়েকদশক ধরে যা দেখছি তাতে কি আদৌ কোনো ভরসা আছে? রাজনীতি কি তারুণ্য বা শিশু কিশোরদের নিয়ে ভাবে? বুঝতে চায়, কিভাবে এদের মানসিক গঠন বিপর্যস্ত করা হচ্ছে? বলছিলাম উত্তেজনার কথা। এখনতো প্রায় এমন অবস্থা ঘুম ভেঙে যদি দু’একটা অপমৃত্যু, ধর্ষণ বা হুমকির খবর না দেখি মনে হয়, দেশ আছে তো দেশের জায়গায়? এমন অস্বাভাবিক অবস্থা ও গা সওয়া হয়ে গেছে দেশের মানুষের। সমাজ ও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ এভাবে রাজনীতির হাতে ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল না। দেখবেন যেখানে যখন কোনো প্রতিকূলতা বা বিপর্যয় সামাল দেওয়া যায় না, সবাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ করে, হাত পাতে বা সমাধান চায়। এমনই বেহাল দশা একদা রাগী, অভিমানী দেশ ও বঙ্গবন্ধুর জন্য নিবেদিত ঝুঁকি নেওয়া কবিও হাত পাতেন। তাও গোপনে আবডালে না। সরাসরি লিখে বা সামাজিক মিডিয়ায় প্রকাশ্যে। এ ঘটনাটিকে আমি ব্যক্তিসম্পর্কের বাইরে রাখায় তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও আমার ধারণা এর ভিতর দিয়ে আমাদের দেউলিয়াত্ব বেরিয়ে এসেছে। সঙ্গে আমরা এও দেখলাম, বাঙালি আসলেই কেউটে হয়ে জন্মালেও মরে ঢোরাসাপ বা বিষহীন নাগের মতো।
সামাজিক সমস্যা সাম্প্রদায়িকতা, আমরা বলছি রাজনীতিকে সামাল দিতে। যারা উস্কে দেবে তারা কেন সামাল দিতে আসবে? সমস্যা হচ্ছে পরিবারে মানুষের বিশ্বাস এখন শূন্যের কোঠায়, তাও বলছি রাজনীতির দোষ। চারদিকে আগুন জ্বালিয়ে দুদল, মানুষ একদল আরেক দলের বিরুদ্ধে লিখছে, বলছে আর ঝগড়া করছে। দেশের মানুষকে বলছে সীতার মতো অগ্নি বা আগুনের ভিতর দিয়ে পার হয়ে যেতে। উত্তেজনা ছড়ানোর জন্য ফাঁসি, বিচার, শাস্তি বা জাগরণ থেমে যাবার পর এখন আমরা টাটকা রক্তে মজেছি। এ প্রতিকূলতা বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম বা তারুণ্যকে ভালো রাখবে না। এমনদিন হয়তো আসছে এরা বলবে, আয় তুই শেখ হাসিনা আমি খালেদা জিয়া আমরা ফাইটিং করি বা টিভিতে গেলেই হাত পা কাঁপিয়ে তার স্বরে ঝগড়া করবে।
বদলে যাও বদলে দাও নামে একটা পপুলার সেøাগান দিয়ে এগোতে চাওয়া সমাজে অনেক কিছুই বদলে গেছে। উত্তেজনার দেশে আর কিছুদিন পর বন্ধু বন্ধুর গলায় ছুরি চালিয়ে বলবে না তো, এই যে বদলে গেলাম।
লেখক : সিডনি প্রবাসী, কলামিস্ট, বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন