নিজভূমে পরবাসী স্বদেশ আমার!
হাবীব ইমন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধ ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ থেকে একটি স্তবক দিচ্ছিÑ ‘ধর্ম বলে, মানুষকে যদি শ্রদ্ধা না কর তবে অপমানিত ও অপমানকারী কারও কল্যাণ হয় না। কিন্তু ধর্মতন্ত্র বলে, মানুষকে নির্দয়ভাবে অশ্রদ্ধা করিবার বিস্তারিত নিয়মাবলী যদি নিখুঁত করিয়া না মানো, তবে ধর্মভ্রষ্ট হইবে। ধর্ম বলে, জীবকে নিরর্থক কষ্ট দেয় যে সে আত্মাকেই হনন করে। প্রাচীন যুগের প্রতিটি ধর্মতন্ত্রই মনুষ্যত্ব-বিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে উদ্ভূত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষ, সাধারণ জনগণের মৌলিক চাহিদা থেকেই পুরনো ধর্মতন্ত্র প্রতিবাদ উত্থিত হয়েছে ও নতুন নতুন ধর্মতন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছে।
একটা সময় ছিল যখন বিরোধিতার সম্মুখিন হলে সরকার অকাট্য যুক্তি এবং তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণের সহায়তায় নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে বিরোধী বক্তব্যের জবাব দিতেন। মাঝেমধ্যে কটাক্ষও যে করতেন না তা নয়। কিন্তু সেই কটাক্ষেও ব্যতিক্রমহীনভাবে ছিল যুক্তির হীরকদ্যুতি, মেধার ঝলক, শাণিত বুদ্ধির দীপ্তি এবং সহজাত সৌজন্যবোধ। এখন আর সেদিন নেই। যুক্তি ও বিশ্লেষণের বিকল্প হিসেবে উঠে এসেছে মেঠো রসিকতা, বস্তাপচা খেউড়-তরজা আর অতি নিম্নমানের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। এসবে যে যতবড়, সে ততবড় ‘আনুগত্য নেতা’।
ধনীদের কোষাগার আরও পূর্ণ করার জন্য বৃহৎ পুঁজি ও উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর উৎপাদনের জন্য মুহিত সাহেবরা উন্নয়নের যে মডেল খাড়া করছেন, তার জীবন্ত উদাহরণ এখন থেকে কৃষকদের ট্যাক্স দিতে হবে। একদিকে বলা হচ্ছে, জনগণই সবকিছু নির্ধারণ করেন, অন্যদিকে একই সঙ্গে উচ্চারিত হয়, ‘দলই সবকিছু নির্ধারণ করে। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নামে চরম কেন্দ্রিকতা অনুসারি দলের কাছে ক্রমেই জনসাধারণ গুরুত্ব হারায়। দলতন্ত্রই চরম-পরম হয়ে ওঠে। গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিও জায়গা নেয় দলতান্ত্রিক মৌলবাদে। অনিবার্যভাবে জনসাধারণকে নস্যাৎ করার উন্নাসিকতা নেতাকর্মীদের গ্রাস করে।
আমার তরুণ বন্ধু হাবিব হাসিবুর রহমান রিফাতের একটি গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। ‘আমার পূর্বপুরুষ ওপার বাংলা থেকে এসেছে। আমার বড় দাদা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সৈনিক ছিলেন। পেশায় ছিলেন ডাক্তার। কিন্তু সারাদিন আফিমের নেশায় বুদ হয়ে থাকতেন আর বই পড়তেন। ডাক্তারিতে তার মন ছিল না। ’৪৭ এর দেশভাগের পরও অনেক সংগ্রাম করে না পেরে অবশেষে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। কিন্তু বড় দাদা আসেননি। তিনি বলেছিলেনÑ ‘বেশ্যার দেশ পাকিস্তানে যাব না। বাংলাদেশ হলে ভেবে দেখতাম।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তার ছেলে এদেশে চলে আসেন। তিনিও এদেশে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু ’৭৫ এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তিনি ছেলেকে একটি চিঠি পাঠালেন। চিঠিটির সারসংক্ষেপ ছিল এই : ‘বেশ্যার সন্তানেরা আজও বাংলাদেশে আছে।’
লেখক : কলামিস্ট / সম্পাদনা : জব্বার হোসেন