রোড টু গুপ্তহত্যা
শিশু যখন কৈশোরে পদার্পণ করে নিজের পছন্দ-অপছন্দ আলাদা করতে শিখে। তখন থেকেই তার নিজস্ব জগৎ তৈরি হয়। ছোটবেলার সেই ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন তাকে যতটা না প্রভাবিত করে তার চেয়ে বেশি আকর্ষিত করে সামনের জগৎটা। নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনগুলো এই বয়সের কিশোরদের টার্গেট করে তাদেরকে সহযোদ্ধা হিসেবে দলে ভেড়ানোর প্রস্তুতি নেয়। বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের মতাদর্শকে উপস্থাপন করে তাদের যাত্রায় শামিল হবার আমন্ত্রণ জানায়। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সদস্য রিক্রুট করা খুবই সহজ। নতুন সদস্য সংগ্রহে তাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্কের সাহায্য নেয়। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ছাড়াও বেকার ও অভাবগ্রস্ত যুবকরা জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত হচ্ছে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য, ৭২-এর সংবিধান থেকে সরে যেয়ে শিক্ষাব্যবস্থার নানামুখী প্রচলন, বিশেষত বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষার অপ্রতুলতা সমাজে অসন্তোষ বাড়াচ্ছে। এর ফলে জঙ্গিবাদ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী মাদ্রাসা থেকে পাশ করে বের হচ্ছে। এই মাদ্রাসা শিক্ষাগ্রহণের পর খুব কম সংখ্যকই নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে পারছে। আবার চাকরির বাজার সংকুচিত হওয়ায়, পাশ করে বের হবার পর তাদের মধ্যে একধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হয়। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো এ সুযোগটিকে কাজে লাগায়। তাদের কাফেলায় আদর্শিক জিহাদি সহযাত্রী হিসেবে শামিল হবার আমন্ত্রণ জানায়। পরকালে বেহেশতবাসী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে সে খেলাফত প্রতিষ্ঠায় নিজেকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী হয়। দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা না রেখে নিজেই আইন হাতে তুলে নেয়। পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, ‘এ কারণেই আমি বনী ইসরাঈলের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে, সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে। এবং যে কারও জীবন রক্ষা করে, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করে। (সুরা আল মায়িদাহ, আয়াত নং-৩২)।’
ইতিহাস বলে, একাদশ শতকের শেষ ভাগে ইরানে হাসান আস সাব্বাহর নেতৃত্বে একটি দল গঠন হয় যারা রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য গুপ্তহত্যায় জড়িত ছিল। তারা নিজারি ইসমাইলিয়া শিয়া সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সুন্নি মুসলমান ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের দ্বিমুখী চাপে তারা কোণঠাসা অবস্থায় ছিল। হাসান সাব্বাহর দলের সদস্যরা ইরানের আলআমুত পাহাড়ে তাদের আস্তানা গড়ে তোলে। সেখানে নতুন সদস্যদের ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি ‘গুপ্তহত্যা’ প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। সদস্য সংগ্রহের পর তাদেরকে ‘হাসিস’ মাদক সেবন করানোর পর মত্ত অবস্থায় বেহেশত সদৃশ কৃত্তিম শীষমহলে নিয়ে বলা হতো, যদি কাজ হাসিল করতে যেয়ে শাহাদৎ বরণ করে, তবে এই বেহেশতে তাদের জায়গা হবে। সেখানে সুন্দর, গাছপালা, পাখি, ফলমূল ইত্যাদি এমনকি তাদের মনোরঞ্জনের জন্য সুন্দরী হুর রয়েছে। এ কারণে নেশাদ্রব্য ‘হাসিস’ নাম থেকেই ‘হাসাসিন’ শব্দের উৎপত্তি, যা পরবর্তীতে ‘এসাসিন’ নামে ইংরেজি অভিধানে সংযুক্ত হয়েছে। এইভাবে হাসান সাব্বাহ তার দলের শিক্ষানবিশ সদস্যদের বিভিন্ন অলীক স্বপ্ন দেখিয়ে পথভ্রষ্ট করে তাদের সাহায্যে গুপ্তহত্যা চালাত।
দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংক, বীমা, কোচিং সেন্টার, হাসপাতাল, এনজিওর মাধ্যমে জঙ্গিবাদের অর্থ পাচার করা হয়। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো বরাবরই বিদেশি সাহায্য নিয়ে আসছে। তারা ওইসব অর্থ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানে লগ্নি করেছে। এর থেকে প্রাপ্ত লাভের টাকা তারা জঙ্গি তৎপরতায় ব্যবহার করছে। বিশেষ করে সীমান্তগুলোতে তারা স্বর্ণ চোরাচালানের কাজে অর্থ লগ্নি করে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মানুষের মস্তিষ্ক পচন ধরলে যেমন সারাদেহে পচন শুরু হয়, তেমনি রাজধানী ঢাকাকে যেকোনো মূল্যে সুরক্ষা করতে হবে। কারণ রাজধানী হচ্ছে একটি দেশের মস্তিস্ক। যেকোনো অবস্থায় এই মস্তিষ্কে আক্রমণে জিরো টলারেন্স দেখতে হবে। জঙ্গিরা সরকারের অবস্থান বুঝতে পেরেই রাজধানীর বাহিরে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। জঙ্গিদমনে সরকারের প্রাথমিক সফলতা এখানেই।
লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা, জাবি
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন