ফুটবল বিস্ময় মেসির বিদায়
ইমরুল শাহেদ, এল আর বাদল : তীব্র, ঝাঁঝাল গন্ধ তখন মাঠ ও গ্যালারিজুড়ে! এই তীব্র ঝাঁঝ সহ্য হচ্ছিল না। কিছুতেই সহ্য হচ্ছিল না! ডাগ আউটে বসে। চোখ জ্বলছিল, গলা-বুক জ্বলছিল। বলা ভালো সারাশরীরটাই জ্বলছিল! আগুন, আগুন বেরোচ্ছিল যেন কান দিয়ে। তার।
স্টেইন গান, এ কে ৪৭-র মতো ক্যামেরাগুলো তাক করেছিলেন ফটোগ্রাফাররা। অনেকক্ষণ ধরেই। সাটার নয়, যেন ট্রিগারে হাত রাখা! এক বিন্দু আবেগ গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষা শুধু। পড়লেই লেন্সবন্দি! তারপর সগর্বে ঘোষণা করা যাবে, ‘এই তো ধরা পড়ে গিয়েছেন।’ কেউ কেউ মাতব্বরী করে, কেউ কেউ বড়াই করে, কেউ আবার তাচ্ছিল্যের সুরে বলবেন, পালাবে কোথায়? যতই তুমি ড্রিবল জানো, যতই তুমি পাসিং জানো, তোমার জারিজুড়ি টিকবে না আমাদের সামনে। তোমাকে বারবার বধিবে চিলি আর আমরা।’
ডাগ আউটে বসে তাচ্ছিল্যের সে সুর, মাতব্বরীর সেই কায়দা, বড়াইয়ের সেই ধরন কী বুঝে ফেললেন? শুনে ফেললেন? ধরে ফেললেন? হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ। তাই তো ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা, দিগন্তরেখা ছাপিয়ে যাওয়া হতাশা আর এক পৃথিবী অভিমান নিয়ে বিশ্বের লক্ষ-কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নিয়ে ফেললেন- লিওনেল মেসি।
দেশের হারের থেকে মেসি-হারার কষ্ট অনেক বেশি, বুঝিয়ে দিল আর্জেন্টিনা। খেলা শেষ হওয়ার আধ ঘণ্টা আগেও মেটলাইফ স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনা সমর্থকরা ভাবতে পারেননি এভাবে তাদের মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়বে! হঠাৎ তার অবসর ঘোষণায় হতবাক গোটা ফুটবল দুনিয়া। দেশের হয়ে ১১ বছর খেলেছেন তিনি। ম্যারাডোনার পর যদি দেশকে নতুন করে কেউ বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখান, তিনি হলেন ফুটবল জগতের বিস্ময় মেসি। তার আকস্মিক বিদায়ের ঘোষণায় অবাক হওয়া সতীর্থরা ঘোর কাটার আগেই তাদের বিদায়ের কথাও জানিয়ে দিলেন। তাদের মধ্যে আছেন আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের সার্জিও আগুয়েরো, সার্জিও রোমেরোসহ আরো কয়েকজন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, মেসির অবসরের পরপর অবসরের ঘোষণা দিতে চলেছেন হাভিয়ের মাশচেরানো, আগুয়েরো, লুকাস বিগলিয়া, এভার বানেগা, ডি মারিয়া এবং হিগুয়েনসহ আরও বেশ কয়েকজন। তবে মেসির সতীর্থ আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের গোলরক্ষক সার্জিও রোমেরো সরে দাঁড়ানোর কথা ভাবলেও তিনি মনে করছেন, মেসি তার সিদ্ধান্ত বদলাতে পারেন। এটা হুট করে নেওয়া একটি ডিসিশান। তবে প্রেক্ষাপট ভিন্ন। মেসি বেশ দৃঢ়ভাবেই বলছেন তার বিদায় নেওয়ার বিষয়টি।
প্ক্ষান্তরে মেসির অবসরের ঘোষণায় রীতিমতো অবাকই হয়েছেন চিলির গোলরক্ষক ক্লদিও ব্রাভো। তার চোখে মেসিই বিশ্ব ও ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়, ‘আমি মনে করি, সে (মেসি) বর্তমান ফুটবল বিশ্ব ও ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়। সবাইকে অবশ্যই এটি বুঝতে হবে। এটা টিম ওয়ার্কের খেলা, যখন কেউ জিতবে বা হারবে তখন সে সাফল্য বা ব্যর্থতার ভার সবার কাঁধেই বর্তায়।’ যদিও মেসির সতীর্থরা বলছেন, মেসি তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে পারেন। গোলরক্ষক সার্জিও রোমেরো বলেন, ‘আমি মনে করি, মেসি আবেগের বশেই এমনটি বলেছে, কারণ একটি চমৎকার সুযোগ আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। মেসিকে ছাড়া আমি জাতীয় দল চিন্তাই করতে পারি না। আমার বিশ্বাস, তিনি তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবেন।
মেসি যে সিদ্ধান্তটা নিলেন সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক। বিশ্ব ফুটবলের জন্যই দুঃখের। অসাধারণ একজন খেলোয়াড়। এ রকম খেলোয়াড় রোজ রোজ জন্মায় না। তৈরিও হয় না। সেই খেলোয়াড় কষ্ট পেয়ে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলেন কেন? কারণ উনি অপরাধবোধে ভুগছেন। দেশকে কিছু দিতে না পারার কষ্টটা বুকে নিয়ে তাই সরে যেতে চাইছেন। কতটা কষ্ট পেয়ে এটা করেছেন মেসি, সেটা কেউ বুঝতে পারছে না!
পৃথিবীর সকলেই পেনাল্টি মিস করে। ওঁর সমালোচনা যারা করছেন সেই পেলে, ম্যারাডোনারাও মিস করেছেন। জিকো থেকে শুরু করে কাউকে বাদ দেওয়া যায় না। পৃথিবী বিখ্যাত খেলোয়াড়ই কোনো না কোনো সময় পেনাল্টি মিস করেছেন। যারা পেনাল্টি মারে তারাই মিস করেন। এই তো রোনাল্ডোই কত মিস করছেন। আজকে মেসি এত কষ্ট পেয়েছে যে, কিছু প্রকাশই করতে পারছে না। যে কারণে খেলা ছেড়ে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন।
২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে হারের পর, টুর্নামেন্টের সেরা হওয়ায় মঞ্চে দাঁড়িয়ে পুরস্কার নিতে গিয়েও বিড়বিড় করে আওড়েছিলেন, ‘সেরা হয়েছ তো কী? দেশের হয়ে জিততে পারোনি তো।’ কী তীব্র সমালোচনা! নিজেই নিজের! কে শুনছে, কে, কী ভাবছে এসবের পরোয়া না করেই করেছিলেন! করার সাহস দেখিয়েছিলেন! নিন্দুকরা কিন্তু সেই আত্মসমালোচনার মর্ম বোঝেনি। আর্জেন্টিনা কিন্তু সেই আত্মসমালোচনার কদর করেনি। বোঝেনি বলে, করেনি বলে এত, এত তাড়াতাড়ি বাগানের সেরা ফুলটা, দেশের সেরা শিল্পীকে হারিয়ে ফেলল আর্জেন্টিনা! পরপর দুবার কোপার ফাইনালে হার। ২০১৪-র বিশ্বকাপ ফাইনালে হার। ট্রফির এত, এত কাছে এসে, এত, এত দূরে সরে যাওয়া। সহ্য হত কি কারও? হলে হত। তার হয়নি। একই যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে বারবার যেতে যেতে, একই কাঁটা বিছানো পথে বারবার হেঁটে, রক্ত ঝরিয়ে ক্লান্ত হয়ত হয়নি শরীর। কিন্তু মন? তার হদিস আদৌ কি কেউ রেখেছে? তার সেই মনের দগদগে ক্ষতটায় কোনও প্রলেপ লাগানোর উদ্যোগ কি কেউ নিয়েছে? না, নেয়নি। উল্টে ক্ষতটা খুঁড়ে খুঁড়ে আরও দগদগে করেছে। তাই তো মাত্র ২৯-এ আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নিতে বাধ্য হলেন মেসি। হারকে তিনি ভয় পান না। বিপক্ষকে তো নয়ই। তবে ঘৃণা করেন, কিছু স্বার্থপর মানুষকে। যাদের স্বার্থপরতায় চাপা পড়তে পড়তে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে অপমৃত্যু ঘটল এক দেশপ্রেমিকের! তার দেশভক্তির। অবসাদ আর চূড়ান্ত অভিমানে মেসি সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর কী বললেন? ‘জাতীয় দলের হয়ে আমার খেলা শেষ। আর খেলছি না। খেলব না। সিদ্ধান্তটা একান্তই আমার। এই সিদ্ধান্তটা নিজের জন্য নিয়েছি। আর যারা,এটাই চেয়েছিলেন, তাদের জন্যও নিয়েছি। আমি সবরকমের চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু না, পারলাম না দেশকে চ্যাম্পিয়ন করতে।’
২০০৫ থেকে দেশের সিনিয়র দলের হয়ে খেলছেন। ১১৩ ম্যাচ খেলেছেন। করেছেন ৫৫টি গোল। দেশের সর্বোচ্চ গোলদাতা। এ তথ্যগুলো বৃথা মনে হচ্ছিল ওই মুহূর্তে! প্রথমে ইনস্টাগ্রামে নিজের সিদ্ধান্ত জানান মেসি। পরে দক্ষিণ আমেরিকার টেলিভিশন চ্যানেলে কান্নাভেজা গলায় মেসি বলেছেন, একই কথাগুলো। নিজেকে ওই সময় কিছুতেই সামলাতে পারছিলেন না মেসি। বারবার বুজে আসছিল গলা, ‘খুব কঠিন মুহূর্ত। এখন কোনো কিছুর ব্যাখ্যা দিতে চাই না।’ আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের টুইটারে পরে মেসি লিখেছেন, ‘ড্রেসিংরুমে বসে বসেই মনে হল, না, আর নয়। জাতীয় দলের সঙ্গে আমার চলার পথটা এখানেই শেষ। আর নয়।’ মাঠ ছাড়ার আগে, মাঠ ছেড়ে ড্রেসিংরুমে ফিরে, হয়ত হোটেলে ফিরেও খুব, খুব কেঁদেছেন তিনি। তার সেই আবেগ ধরেছেন বটে কিছু তুখোড় আলোকচিত্রী। কিন্তু তার মন? সেই মনে কি আদৌ কোনো ফ্ল্যাশের ঝলক ফেলতে পারলেন আলোকচিত্রীরা? আদৌ পারলেন তার আর্জেন্টিনীয় সমর্থকরা?
পারলে, এভাবে এক শিল্পীর বিদায় হত না। পারলে, ফুটবলে শুধু রোবটরা পরে থাকত না! সম্পাদনা : পরাগ মাঝি