যাবজ্জীবনে আমৃত্যু কারাদ- নাকি ৩০ বছর বিভ্রান্তি দূর করতে সরকারি সিদ্ধান্তের অপেক্ষা
নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী ও এস এম নূর মোহাম্মদ : যাবজ্জীবন মানে হলো একেবারে রেস্ট অব দ্য লাইফ। আমাদের জেল কোড অনেক পুরনো। এটা নিয়ে ব্রিটিশ আমলে অনেক জগাখিচুড়ি হয়েছে। যাবজ্জীবন কারাদ- নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে। এটা নিয়ে অপব্যাখ্যাও রয়েছে। গত রোববার গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শন করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এসব কথা বলেন। প্রধান বিচারপতির এমন বক্তব্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে দেশের অন্য জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের মধ্যে।
যাবজ্জীবন দ- নিয়ে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তবে ভিন্ন মত দেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, দ-বিধির ৫৭ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে যাবজ্জীবন কতদিনে হবে। যাবজ্জীবন কারাদ-ের আক্ষরিক অর্থ যাই থাকুক না কেন, যেহেতু আমাদের দ-বিধিতে স্পষ্ট বিধান রয়েছে, ব্রিটিশ আমল থেকে এটি প্রথমে ছিল ২০ বছর। ১৯৮৫ সালে এটা বৃদ্ধি করে ৩০ বছর করা হয়।
আইন পরিবর্তন না করে যাবজ্জীবন দ- আমৃত্যু প্রচলিত দ- বিধি আইনে প্রযোজ্য হবে না বলেও জানান খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস অ্যাক্টে যাবজ্জীবন বলতে আমৃত্যু বলা হয়েছে। সেটা বিশেষ আইন, এখানে তা প্রযোজ্য হবে না।
এদিকে, বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, দ-বিধির ৫৭ ধারায় যাবজ্জীবনের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে সেটাই থাকা উচিত। আইনে যাবজ্জীবনের সংজ্ঞা স্পষ্ট। তাই আইন পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোনো ব্যাখ্যা আসতে পারে না।
এছাড়া জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, দ-বিধির ৫৭ ধারা অনুযায়ী ইমপ্রিজনমেন্ট ফর লাইফ মানে ৩০ বছর। আমি মনে করি এখনও ৫৭ ধারা সংশোধন হয়নি। তাই এটি ৩০ বছরই আছে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে যাদের ১৯৮৫ সালের পর যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়া হয়েছে তারা ৩০ বছর হিসাবেই সাজা ভোগ করছেন। চলতি বছরেই অনেকের সে হিসাবে যাবজ্জীবন কারাদ-ের ৩০ বছর পূর্তি হচ্ছে। তারা এখন মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছেন। কিন্তু এখনও তাদের মুক্তি মিলছে না। এই মুক্তি না মেলার কারণে তাদের অনেকেই প্রধান বিচারপতির কাছে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, আমাদের সাজার মেয়াদ ৩০ বছর হয়ে গেছে কিন্তু আমরা মুক্তি পাচ্ছি না। আবার যাদের সাজার মেয়াদ ৩০ বছর হয়ে গেছে তাদের কেউ কেউ মুক্তিও পেয়েছেন। এটাও তারা প্রধান বিচারপতির কাছে তুলে ধরেছেন। আর এই প্রশ্নের ব্যাপারে প্রধান বিচারপতিও তার জবাব দিয়েছেন। আগের নিয়মে যাবজ্জীবন দ-প্রাপ্ত ব্যক্তিরা ৩০ বছর সাজা খাটছেন। সেই হিসাবে তারা মেয়াদ শেষ হলে মুক্তি পাওয়ার আশায় দিন গুণছেন।
অনেক আইনজ্ঞ মনে করেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলার ঘটনায় জামায়াতের সাবেক আমির মাওলানা গোলাম আজম ও আপিল বিভাগে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর যখন সাজা দেওয়া হয় তখন তাদের বেলায় যাবজ্জীবন কারাদ-ের বিধান দিলেও সেখানে স্পষ্ট করেই বলে দেওয়া হয়েছে তাদের শাস্তি হবে আমৃত্যু কারাদ-। তারা মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কারাগারেই থাকবেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক আদালতেও এই সব মামলার রায় আপিল বিভাগ যেভাবে দিচ্ছে সেখানে বিচার হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন অনুযায়ী। সেখানে দেশীয় দ-বিধিতে শাস্তি দেওয়া হয়নি। এই কারণে সেখানে বিচারপতিগণ আসামিদের জন্য আমৃত্যু কারাদ- দেওয়ার কথাটি বলতে পারেন। কিন্তু অন্যান্য আসামিদের বেলায় দ-বিধির হিসাবেই শাস্তি দিতে হবে। সেই হিসাবে তাদের বিচার হবে। তারা কেউ যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত হলে ৩০ বছর সাজা ভোগ করবেন। জেল কোডের হিসাব মতে, ৩০ বছর সাজা শেষ হওয়ার পর বেঁচে থাকলে মুক্তি পাবেন। কারণ দ-বিধিতে যাবজ্জীবন কারাদ-ের মেয়াদ বলে দেওয়া আছে। সেই হিসাবেই আদালত কাজ করবে। তবে, সরকার যদি কোনো কারণে মনে করবে এই আইনের পরিবর্তন দরকার তাহলে সরকার আইনের সংশোধনী এনে নতুন যে বিধান করবেন সেটাই কার্যকর করা হবে। এখন সরকার কি করবে সেটাই দেখতে হবে। সম্পাদনা : পরাগ মাঝি