শান্তিচুক্তির ১৮ বছর পরও পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি
মমিনুল ইসলাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ফিরে : অশান্ত পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত হয় ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’। সশস্ত্র সংগঠন জেএসএসর (সন্তু লারমা) সঙ্গে করা এ চুক্তি এরই মধ্যে পার করেছে সাড়ে ১৮ বছর। পূরণ করা হয়েছে চুক্তির বেশিরভাগ শর্ত। কিন্তু দৃশ্যত এখনও বন্ধ হয়নি অপার সম্ভাবনাময় পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি।
প্রতিনিয়তই উপজাতি সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, ধর্ষণসহ কোনো না কোনো অপরাধের শিকার হচ্ছেন নিরীহ বাঙালিরা। এমনকি এসব অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না নিরীহ পাহাড়িরাও। এ অবস্থার উত্তরণে পাহাড়ে অতি শিগগিরই অস্ত্র উদ্ধার অভিযান ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেনা ক্যাম্প স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
একটি গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, পুরো পার্বত্য অঞ্চলে ‘রাষ্ট্রীয় স্টাইলে’ চাঁদা আদায় ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রমে নিয়োজিত রয়েছে জেএসএস’র পাঁচ হাজার সশস্ত্র প্রশিক্ষিত কর্মী। সেনাবাহিনী স্টাইলে মেজর, কর্নেল ইত্যাদি পদবিও রয়েছে তাদের এবং প্রত্যেকেই বেতনভুক্ত। সামান্য ঝাড়ের বাঁশ থেকে শুরু করে সবকিছুতেই নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিতে হয় তাদের।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ এক-দশমাংশ ভূখ- নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান)। পাহাড়-পর্বত, নদীনালা ও গাছপালা বেষ্টিত মনোরম দৃশ্যের এ ভূমিতে রয়েছে বসবাসরত বাঙালি ও ১৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত। কিন্তু আজ উপজাতি নেতৃত্বের বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকা-ে তা হুমকির মুখে বলে অভিযোগ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। তারা বলছেন, জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর মতো সশস্ত্র সংগঠগুলোর খুন, গুম, চাঁদাবাজি অপহরণ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না ক্ষমতাসীন আওয়মী লীগের নেতাকর্মীরাও।
গত ১৫ এপ্রিল বান্দরবানের লামায় উপজাতি সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে খুন হয় তিন বাঙালি গরু ব্যবসায়ী। এ ঘটনায় তিন ত্রিপুরা সন্ত্রাসীকে অস্ত্রসহ আটক করা হয়। ১৩ জুন বোয়াংছড়ি উপজেলায় শাহিনা আক্তার (২০) নামে এক বাঙালি গৃহবধূকে প্রকাশ্যে দিবালোকে অস্ত্র ঠেকিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করে এক উপজাতি সন্ত্রাসী। একই দিন অস্ত্রের মুখে অপহরণ হয় বান্দরবানের আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক ইউপি সদস্য মংপু মারমা। এ ঘটনায় জেএসএসে’র ৩৬ জনকে আসামি করে মামলা করেছে পরিবার। ৩০ মে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে জেএসএস কর্মীরা মুকুল কান্তি চাকমা নামে অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা সার্জেন্টকে ডেকে নেওয়ার পর আজও নিখোঁজ রয়েছে সে।
এরও আগে গত বছর ৩১ ডিসেম্বর রাঙামাটির সাজেকে এক সেনা কর্মকর্তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে তার গাড়িতে আগুন দেয় উপজাতি সন্ত্রাসীরা। ২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ৫ জেএসএস (সংস্কার) সন্ত্রাসী। উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র। একই বছরের ২৬ জুলাই রাঙামাটিতে জেএসএস-ইউপিডিএফ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ৩ জন এবং ২৬ জানুয়ারি খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে জেএসএস-ইউপিডিএফ’র আরেকটি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। এর বাইরে বিভিন্ন সময় উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি ভারী আগ্নেয়াস্ত্র। শান্তিচুক্তির সময় শান্তিবাহিনীর অস্ত্রের আত্মসমর্পণ যেমন প্রমাণ করেছিল তাদের কাছে আধুনিক অস্ত্রের কোনো অভাব ছিল না। ঠিক সম্প্রতি এসব ঘটনা পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্রের উপস্থিতিকে নতুন করে স্পষ্ট করে। এছাড়াও জেএসএস প্রধান সন্তু লারমার শান্তিচুক্তি ‘পূর্ণ’ বাস্তয়াবনের অযৌক্তিক দাবিতে সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক সত্যিই ভাবিয়ে তোলে।
রাঙামাটির বিলাইছড়ি থানার ওসি মো: মঞ্জুরুল আলম মোল্লা বলেন, পাহাড়ি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধের খবর আসে। কিন্তু প্রসাশনের কাছে অতি গোপনেও মুখ খুলতে চায় না কেউ। চলতি বছরে পুরো থানায় মাত্র তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। অপরাধ ঘটা সত্ত্বেও মামলা না হওয়ার কারণ সম্পর্কে বলেন, এখানকার বাস্তবতাটা ভিন্ন।
এদিকে ভুক্তভোগী সাধারণ পাহাড়ি ও বাঙালিরা বলছেন, জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর মতো সশস্ত্র সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে বাসায় অক্ষত থাকা একেবারেই অসম্ভব। তাদের শঙ্কা দুর্গম পাহাড়ে প্রশাসনের অনুপস্থিতিতে যে কোনো ধরনের ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হতে পারেন তারা। এছাড়াও পর্যাপ্ত লোকবল ও আধুনিক অস্ত্রের অভাবের পাশাপাশি দ্রুত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে অক্ষম পুলিশ প্রশাসন। তাই এক্ষেত্রে একমাত্র সেনাবাহিনীকেই উপযুক্ত বলে মনে করেন তারা।
রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অংচাখই কার্বারী জানান, এখানে অস্ত্রধারী জেএসএসের এতটাই প্রভাব সরকারি দলের লোক হয়েও চাঁদাছাড়া টিকতে পারছেন না তারা। এমনকি দোকান-পাটও বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানান তিনি।
গত বুধবার বান্দরবান প্রেসক্লাবের সামনে সমবেত হয়েছিলেন ভুক্তভোগী পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে প্রায় কয়েকশ সাধারণ মানুষ। সমাবেশে বক্তারা জেএসএস’র অব্যাহত চাঁদাবাজি, খুন, গুম, অপহরণের প্রতিবাদ জানান। উপজাতি কোটার পুরোটাই একাকি চাকমারাই ভোগ করে উল্লেখ করে এক্ষেত্রে সব নৃগোষ্ঠীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানান তারা। এছাড়া বান্দরবানের পর্যটনশিল্পকে বাঁচাতে দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া ঐতিহাসিক স্বর্ণমন্দির পুনরায় খুলে দেওয়ার দাবি জানান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তর বন বিভাগের বাঘাইহাট রেঞ্জের এক বন কর্মকর্তা জানান, সারাদেশের চেয়ে পাহাড়ের অবস্থা একেবারেই ভিন্ন। বিশেষত রাঙামাটিতে সাধারণ সরকার ছাড়াও অন্য একটি ‘সরকার’ কাজ করে। যেটাকে তারা কখনই উপেক্ষা করতে পারেন না। কোনো সুযোগও নেই। নতুবা তার আগে অপহরণ হওয়া তিন কর্মকর্তার মতোই পরিণতি হতে পারে বলে শঙ্কা তার। এমনকি অদৃশ্য প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া তার নিজের আওতাধীন রিজার্ভ পরিদর্শনে যাওয়াও সম্ভব নয় বলে জানান।
গত বুধবার রাঙামাটি শহরের নিজ বাসভবনে ঢাকা থেকে যাওয়া একটি সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কথা হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র মহিলা এমপি ফিরোজা বেগম চিনুর। আওয়ামী লীগ এমপি বলেন, উপজাতি নেতৃবৃন্দ সবসময়ই সরকারবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। প্রথমত ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের সময় ও পরবর্তীতে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতার সময় তারা মূল স্র্রোতের বিরোধিতা করেছে। এখন তারা বাংলাদেশ সরকারের বিরোধিতা করছে। অর্থাৎ মূল স্রোতের বিপরীতে থাকাই তাদের স্বভাবগত অভ্যাস বলে মন্তব্য করেন তিনি।
গত সংসদ অধিবেশনে নিজের দেওয়া বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে চিনু বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শান্তিচুক্তি করে পাহাড়ের অনেক উন্নয়ন করেছেন। এ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে প্রয়োজন শান্তি-শৃঙ্খলা। কিন্তু একটি সশস্ত্র গ্রুপ চাঁদাবাজি, খুন, গুম. অপহরণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছে।
বান্দরবান জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই-এর ডিডি মো: শাহজাহান গণমাধ্যমের কাছে ৩৯ জন চাঁদাবাজের তালিকা দেন। তাদের সবাই বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্বরত রয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদকে উসকে দিতে সম্প্রতি ভান্তে বেশে পার্শ্ববর্তী দেশের কয়েকজন গোয়েন্দা পাহাড়ে এসে গোপন বৈঠক করে চলে গেছেন বলে জানান তিনি। সম্পাদনা : রাশিদ রিয়াজ