প্লিজ, শিশুদের গিনিপিগ বানাবেন না
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে শুরু থেকেই বিভ্রান্তি ছিল। এ পরীক্ষার সংক্ষিপ্ত রূপ পিইসি হলেও অনেকে একে পিএসসি লিখতেন বা বলতেন। এমনকি অনেক প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমও দিনের পর দিন এ ভুলটি করেছে। কিন্তু প্রশ্ন বিভ্রান্তি নিয়ে নয়, প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। শিক্ষাবিদদের প্রায় সবাই পঞ্চম শ্রেণিপড়ুয়া শিশুদের জীবনের শুরুতেই এমন একটি বড় পরীক্ষায় বসিয়ে পরীক্ষা সম্পর্কে, শিক্ষা সম্পর্কে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন।
গত ১৮ মে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়Ñ প্রাথমিক শিক্ষা হবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত, এতদিন যা ছিল পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। তখন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যেহেতু হাতে সময় বেশি নেই, তাই অন্তত এ বছর শেষবারের মতো পঞ্চম শ্রেণি শেষে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা হবে। এরপর থেকেই অভিভাবকরা এ বছর থেকেই পিইসি পরীক্ষা তুলে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলনে নামেন। তাদের যুক্তি ছিল, পিইসি পরীক্ষা যেহেতু থাকবেই না, তাহলে আর এ বছর শিশুদের কষ্ট দেওয়া কেন? আর এ বছর পিইসি পরীক্ষা দিলে তিনবছর পর এ শিশুদের আবার পিইসি পরীক্ষা দিতে হবে। কারণ তখন পিইসি হবে অষ্টম শ্রেণি শেষে।
বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। আদালত রুলও ইস্যু করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত গত ২১ জুন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান, চলতি বছর থেকেই পঞ্চম শ্রেণি শেষে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি নিশ্চিত হয়েই বলছি, এ বছর থেকেই পঞ্চম শ্রেণি শেষে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা আর থাকবে না। একেবারে অষ্টম শ্রেণি শেষে হবে এ পরীক্ষা। শিগগিরই এ সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে।’ সাংবাদিকদের সংশয় দূর করতে মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমরা যা বলি বা কর্তব্য পালন করি, তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েই করি।’ তার সিদ্ধান্তে আনন্দের বান ডেকেছিল পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ঘরে ঘরে।
কথামতো গতকাল মন্ত্রিসভায় প্রস্তাবটি উঠেছিল। কিন্তু মন্ত্রিসভা প্রস্তাবটি অনুমোদন করেনি। মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগের মতোই পঞ্চম শ্রেণি শেষে পিইসি এবং অষ্টম শ্রেণি শেষে জেএসসি পরীক্ষা হবে। সিদ্ধান্তটা শুনে আমার বিশ্বাস হয়নি। অনেকবার ক্রস চেক করে তবে নিশ্চিত হয়েছি। সিদ্ধান্তটা এতই অবিশ্বাস্য যে, দুয়েকটি অনলাইন, মন্ত্রিসভা প্রস্তাবটি অনুমোদন করেছে বলে সংবাদও ছেপেছে।
পিইসি পরীক্ষা থাকা উচিত কি উচিত নয়, সেটা নিয়ে আলাদা বিতর্ক। সে বিতর্ক শিক্ষাবিদরা করুন। আমরা যারা মূর্খ সাংবাদিক খালি বুঝি, আমাদের শিশুদের শিক্ষাজীবন নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলার, শিশুদের গিনিপিগ বানিয়ে এমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিত নয়। এ অধিকার কে দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রীকে, মন্ত্রিসভাকে? মন্ত্রী কেন সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার আগেই, মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের আগেই তা ঘোষণা করে দিলেন? এর দায় কে নেবে? জবাব কে দেবে?
আমার ছেলে প্রসূন এবার জেএসসি পরীক্ষা দেবে। তিনবছর আগে তার পিইসি পরীক্ষার সংগ্রামটা আমি দেখেছি। আমার খুব মায়া লেগেছে প্রসূনের জন্য, প্রসূনদের জন্য। পিইসি পরীক্ষা হবে না শুনে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম, যাক এবার শিশুদের শৈশব চুরি করার যে প্রতিযোগিতায় মেতেছিলাম আমরা, তা থেকে কিছুটা হলেও ছাড়া পাবে আমাদের সন্তানরা। এবার আমার পাশের চেয়ারের সহকর্মী কাজী তাপসের ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। তাই পিইসি নিয়ে এবার যে কানামাছি খেলা হলো, তার প্রতিক্রিয়াটা আমি টের পেয়েছি প্রতিদিন। পিইসি পরীক্ষা হবে না শুনে, শিশুদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। এবার তাদের ঈদ এসেছিল বাড়তি আনন্দ নিয়ে। তারা লম্বা ঈদের ছুটির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কী পোশাক কিনবে? কোথায় বেড়াতে যাবে? ইত্যাদি নিয়েই তাদের ব্যস্ততা। ঈদের আগে আগে এমন একটি সিদ্ধান্ত তাদের মাথায় বাড়ি দিয়েছে। তাপসের ছেলে কাজী অরিত্র ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে, মাথা গরম, সমাপনী বাদ দিয়ে আবার হবে।
অন্যদের কথা জানি না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুবান্ধব। সবসময় তিনি শিশুদের ‘হ্যাঁ’ বলতে বলেন, শিশুদের পক্ষে কথা বলেন। স্কুলে শিশুদের সব ধরনের নির্যাতন বন্ধ হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই। আমার স্ত্রী মুক্তি সবসময় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ফলো করতে পারেনি। মাঝে মধ্যেই প্রসূনকে বকাঝকা, টুকটাক চড়-থাপ্পর দিয়েছে। আর প্রসূন ছেলেবেলা থেকেই তাকে বকা দিলে ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার দেওয়ার’ হুমকি দিতো। কিন্তু তেমন একজন শিশুবান্ধব প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে শিশুদের নিয়ে এমন কানামাছি খেলা হতে পারে, আমার সত্যিই বিশ্বাস হচ্ছে না।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাবটি আরও পর্যালোচনা করতে বলা হয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, শিক্ষার স্তর পরিবর্তনের এ বিশাল কর্মযজ্ঞ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পরবর্তীতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কারণ এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে অবকাঠামোগত, শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণসহ অনেক ধরনের কর্মকা- জড়িত। কোনো আপত্তি নেই। পরীক্ষা নিয়ে নিরীক্ষা চলুক, চলতে থাকুক। দয়া করে সেই নিরীক্ষায় আমাদের সন্তানদের গিনিপিগ বানাবেন না। আপনার মন্ত্রণালয়ের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমে বসে ঠা-া মাথায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করুন। তারপর যা ইচ্ছা তাই চাপিয়ে দিন। কিন্তু একবার হবে না, একবার হবেÑ এমন পেন্ডুলামে দোলাবেন না শিশুদের জীবন।
আমার আশঙ্কা, মন্ত্রী-এমপিদের সন্তানেরা হয় ইংলিশ মিডিয়াম, নয় বিদেশে পড়াশোনা করেন। তাই তারা সম্ভবত শিশুদের মনস্তত্বটা বোঝেন না। নইলে বুঝতেন, এই দোলাচল শিশুমনে কী সাংঘাতিক বিরূপ প্রভাব ফেলে। শুরুতেই তারা বুঝে যায়, শিক্ষা একটি জটিল ও বিরক্তিকর বিষয়। বিশাল কর্মযজ্ঞটা সবচেয়ে ভালো বোঝার কথা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রীর। তিনি কেন, আগপিছ না ভেবে পিইসি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দিলেন? এমন ছেলেমানুষি সিদ্ধান্ত তো পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়ারাও নেবে না।
লেখক : অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
২৭ জুন ২০১৬,