সার্টিফিকেট নয়, গুণগত শিক্ষাই মুখ্য হোক
ড. বদরুল হাসান কচি
শিক্ষার্থীদেরকে পঞ্চম শ্রেণিতেই একটি সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিব নাকি অষ্টম শ্রেণি পার করে, সেই বিতর্ক চলছে জোরেশোরে। বিতর্কটি প্রত্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেমন হচ্ছে তেমনি মন্ত্রী পরিষদেও। স্বাভাবিকভাবেই আলোচনা গড়িয়েছে টেলিভিশন টকশোতে। সেই সূত্রে আমরা যারা লিখি তারাও কিছুটা লেখার উৎসাহ পাই।
শুরুতেই ব্যবহার করা শিক্ষার্থী শব্দটি এখন পরীক্ষার্থী হিসেবেই সমাদৃত। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সবাই কেবল দৌড়াচ্ছে সার্টিফিকেট পাবার কিংবা দেবার প্রতিযোগিতায়। দায়িত্ব নিয়ে বলছি, কারও কাছেই প্রকৃত শিক্ষাটি এখন আর মুখ্য নয়। তবে এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা পরিস্থিতির শিকার।
স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরে আমরা একটি পরিপূর্ণ শিক্ষানীতি পেয়েছি। ২০১০ সালে জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জাতীয় সংসদে তা গৃহীত হয়। নিশ্চয়ই তা বর্তমান সরকারের বড় অর্জন। তাতে বলা আছে, অষ্টম শ্রেণিতেই প্রথম সার্টিফিকেট পরীক্ষা নেওয়া হবে; কিন্তু দুর্ভাগ্য সেই শিক্ষানীতিকে পাশ কাটিয়ে পঞ্চম শ্রেণিতেই প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়ে কোমলমতি বাচ্চাদেরকে মানসিক চাপের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বাচ্চাদের উল্লাস দেখেই আমরা সকলে তৃপ্ত। অথচ তৃপ্ত কি হতে পারছি তাদের প্রকৃত শিক্ষা নিয়ে। একটি মানুষের বেড়ে ওঠা যদি সঠিক না হয় পরে তাকে সঠিক পথ দেখানো দুরূহ হয়ে পড়ে। ব্যক্তির মানস গঠনে যে শিক্ষাটি সেটা শিশুকালেই দিতে হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি মানুষ হবার শিক্ষাটিও তাদের দিতে হয়। অথচ সেই সময়কালে আমরা কীসব সার্টিফিকেটের কথা বলে পাঠ্যবই মুখস্থ করার প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিয়েছি শিশুদের। বলতে দ্বিধা নেই, এই সময়ে চারদিকে তাকালেই বোঝা যায়, একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠছে গভীর শূন্যতায়; তাদের চলনে-বলনে, কথা-বার্তায়, শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় ভীষণ ঘাটতি রয়েছে।
তাই বলছিলাম, পরীক্ষায় পাশের হার আর ফলাফল দেখেই আমাদের অভিভাবক এবং রাষ্ট্র যে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন সেই ফলাফল আদতে দেশকে মর্যাদার আসনে বসাতে সক্ষম হবে না। আমাদের সম্পদের অভাব আছে, তবে মানুষ আছে, সুদূরপ্রসারী চিন্তা থাকলে মানুষই হবে এই দেশের বড় সম্পদ। কেবল সার্টিফিকেট নয়, সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারলে পরবর্তী প্রজন্ম দেশকে আলোকিত করে বিশ্ববাসীর কাছে নিয়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না। আর যদি এভাবেই চলতে থাকে তাহলে কেবল সার্টিফিকেটের স্তুপ তৈরি ছাড়া তেমন কোনো ফলাফল আসবে না। প্রমাণ তো রয়েছে, আমাদের তো কত বিবিএ, এমবিএ, আইবিএ আছে, প্রতিনিয়ত বেরুচ্ছেও। তাহলে কেন দেশের প্রায় সকল বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে শীর্ষপদে বাহির দেশ থেকে লোক এনে প্রতিষ্ঠান চালাতে হয়? এটা কি আস্থার সংকট নাকি যোগ্যতার ঘাটতি? আমাদের রাষ্ট্রের এটাও ভাবা উচিত।
এই দেশ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে কিছু কর্মঠ হাতের একনিষ্ঠ পরিশ্রমের কারণে। এই কর্মঠ হাতের সঙ্গে মেধার সমন্বয় ঘটলে আমাদেরকে আর ফিরে তাকাতে হবে না। আমরাই হব এই অঞ্চলের অবাক করা বিজয়ী দেশ। সে জন্য দরকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রকৃত শিক্ষায় মানুষ করে তোলা। তাই সার্টিফিকেট মুখ্য না হয়ে, শিক্ষাই হোক মুখ্য।
লেখক : আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন