হারিয়ে যাওয়ার চিকচিকে সমীকরণ
প্ল্যান করে কখনও হারিয়ে যাওয়া যায় না। হারিয়ে যেতে হয় হুট করে। চোখের পলকে, এক নিমিষে। হারিয়ে যেতে যেতে বুঝতে পারা যায়, ‘আহা আমি হারিয়ে যাচ্ছি।’ সেই ‘আহা আমি হারিয়ে যাচ্ছি’ কথাগুলো বিষাদে মাখাও হতে পারে কিংবা পুলক প্রবাহের ধারায় ভেসেও যেতে পারে। আমি যতবার হারাতে চেয়েছি ছক কষে, প্ল্যান করে, ততবার ফিরে এসেছি। যুক্তির তোড়ে, এই ভেবে, সেই ভেবে।
ছোটবেলায় আমায় পাখি পড়ানো হতোÑ ‘যদি দেখ হারিয়ে গেছ, ঠিক যেখানে হারিয়েছ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। একটুও নড়বে না। আমরা খুঁজে নিব। বুঝেছ? বলো তো কি বললাম?’
আমার আলাভোলা স্বভাব দেখে বাবা-মা আমায় এমন করেই শিখাতেন, যে কেমন করে হারিয়ে যেয়েও ফিরে আসা যায়।
মনে আছে, আমার প্রথম হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা। বয়স আমার পাঁচ হবে। সামনে ঈদ। আমি, মা আর আন্টি মিলে গিয়েছি কেনাকাটা করতে মার্কেটে। মা আর আন্টি এটা কিনে, সেটা কিনে। আমার তাতে আগ্রহ নেই। আমার চোখ খুঁজে অন্য কিছু। পাশের বাড়ির ড্যানি আপুর নখে চিকচিক করা নেইলপলিশ দেখেছি সেদিন। তার আগে আমি জানতাম নেইলপলিশ শুধু লাল হয়। ড্যানি আপুর হাতের নখের চিকচিকে নেইলপলিশ দেখে বুঝেছিলাম আমার জানাটুকু ঠিক ছিল না। সেই চিকচিকে রূপালি নেইলপলিশ মাখা নখে ড্যানি আপু যখন ক্যারম বোর্ডের স্ট্রাইকারকে আলতো টোকা মেরে কালো সাদাকে পাশ কাটিয়ে, লাল গুটিকে পকেটে ফেলে দিলো, আমার মুগ্ধ মন জেনে গেছিল যে আমারও এমন এক চিকচিকে নেইলপলিশ চাই।
তাই আজ মার্কেটে আমার চোখ তা খোঁজে এদিক সেদিক। আমি দেখি ফুটপাতের ওই পাশেই দোকান, তাতে নেইলপলিশও আছে। সবাই কেনাকাটা করুক, আমি বরং এই ফাঁকে দোকানে নেইলপলিশ খুঁজি। এই ভেবে দোকানে যেয়ে নেইলপলিশ সন্ধান করি। আমি আমার চিকচিকে নেইলপলিশ খুঁজে পাই। আর তখনই মা খুঁজে পায় না আমাকে। মায়ের মুখ থেকে শোনা, মা আর আন্টি পাশে তাকিয়ে দেখে আমি নেই। ঈদের বাজারের ভিড়ে আমি নেই। খুঁজতে থাকে এখানে সেখানে তীব্র আর্তনাদে, ‘বাচ্চা হারিয়ে গেছে, আমাদের বাচ্চা হারিয়ে গেছে।’
খুঁজতে খুঁজতে অল্পক্ষণের মাঝে খুঁজেও পায় আমাকে, দোকানে। চিকচিকে নেইলপলিশের দোকানে। আমি দেখি মা কাঁদছে, আন্টি কাঁদছে। চোখ ভরা পানি নিয়ে মা আমাকে চড় মারে গালে সবার সামনেই এবং সেই ভেজা চোখেই নেইলপলিশটি কিনে দেয় আমাকে। চড় খেয়ে আমি কাঁদি না কিন্তু চড় দিয়ে মা কাঁদতে থাকে। আমি রিকশায় মায়ের কোলে চেপে চিকচিকে নেইলপলিশের কৌটা হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরি। বাড়ি যেতে যেতে ভাবি, মা আমায় মারল কেন? মারল যখন, তবে কাঁদল কেন? অত জটিল সমীকরণ আমি বুঝিনি তখনও। বুঝিনি বলে একটি চিকচিকে নেইলপলিশের কৌটো খুঁজতে হারিয়ে যেতে পারতাম।
আজ সন্ধ্যার মুখে ছাদে যেয়ে দেখি, চাঁদ সর্বস্ব এক আলোর আকাশ। এ জীবনে আমরা সবাই বোধ হয় কখনও কখনও একজন জীবনানন্দ হয়ে উঠি। নইলে এমন জোছনায় হারিয়ে যাওয়ার আদি ইচ্ছে এখনও সময়কে অস্থির করে তোলে কেন? তবে আমি এখন অনেক জটিল সমীকরণ মেলাতে পারি। আমি জানি, হারিয়ে গেলে সেখানেই থেমে যেতে হয়, যেখানে হারালাম। তবেই আবার ঠিক খুঁজে পাওয়া যায়। আমার তাই আর হারানো হয় না, চিকচিকে চাঁদ কিংবা নেইলপলিশের কৌটার খোঁজে। ফিরে আসতে জানলে আর হারানো হয় না। প্ল্যান করেও আর হারানো হয় না। আমি তাই হারিয়ে যেতে যেতে খুঁজে নিই নিজেকে, পূর্ণ চাঁদের মায়ায়।
লেখক : কলামিস্ট
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন