পথশিশুরাই সম্পাদনা প্রকাশ ও বিক্রি করে ‘বালকনামা’
পরাগ মাঝি : আমাদের দেশের মতো আপনি যদি ভারতের কোন শহুরে রাস্তার ট্রাফিক সিগনালে আটকা পড়েন তবে সেখানেও দেখবেন একই চিত্র। আর তা হলো- ছোট ছোট ফুটপাতের ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন ধরণের টুকিটাকি জিনিস বিক্রি করার জন্য আপনার দিকে এগিয়ে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব পণ্য বিক্রি করার জন্য তারা মানুষকে অনুনয়-বিনুনয় এমনকি জোরাজুরি পর্যন্ত করে থাকে। এমনটি আপনার কাছে অর্থহীন মনে হতে পারে। কেউ কেউ ইশ্বরকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারেন এমন অস্বাস্থ্যকর এবং গরীবের জীবন এইসব শিশুদের দেওয়ার জন্য। তবে ভারতীয় পথ শিশুদের নিয়ে আপনার এই অনুভূতিটুকু প্রবল জোরে ধাক্কা খাবে যদি ‘বালকনামা’ পত্রিকাটি তাদের হাত দিয়ে আপনার কাছে এসে পড়ে।
আপনার অবাক না হয়ে উপায় থাকবেনা যখন জানতে পারবেন, ‘বালকনামা’ অর্থাৎ শিশু বিষয়ক ওই পত্রিকাটি আসলে পথ-শিশুদেরই পত্রিকা। শুধু তাই নয়, পত্রিকাটির সার্কুলেশন থেকে শুরু করে সম্পাদনা সবকিছুই ওইসব ছিন্নমূল শিশুরাই করছে। ছোট ছোট এসব ছিন্নমূল সম্পাদকম-লীকে বাধে কদম নামে এক ব্যাক্তি আশ্রয় দিয়েছিলেন। তিনি ‘চিন্তা’ নামে একটি এনজিও’র কর্মকর্তা। এনজিওটি মূলত রাস্তার শিশুদের পুনর্বাসন করে থাকে।
২ রুপি মূল্যের ৮ পৃষ্ঠার ‘বালকনামা’ পত্রিকাটি দিল্লি শহর এবং এর পার্শ্ববর্তী হারিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশের ছিন্নমূল শিশুদের গল্প ও সংবাদ প্রকাশ করে। এটি মূলত শিশুদের উপর যৌন নিপীড়ন, শিশু শ্রম, বাল্য বিবাহ এমনকি পুলিশের নানা অনিয়ম নিয়েও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পত্রিকাটি কোন লাভজনক বিনিয়োগ নয়, চিন্তা এনজিওই এটির অর্থায়ন করে থাকে। দক্ষিণ দিল্লির একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবনে শিশুদের একটি দল এই পত্রিকাটির সম্পাদনা করছে। বালকনামা’র সেসব ক্ষুদে সাংবাদিককে দেখলেই মনে হবে, তারা দারুণ প্রাণচঞ্চল, কোন কিছু শেখার জন্য তাদের প্রবল আগ্রহ, এমনকি দেখা হলে তারা আপনার বিষয়েও জানতে প্রবল আগ্রহ দেখাবে, জানাবে তাদের কথাও। দেখলেই এই ভয়হীন মুখগুলো আপনার মনে চিরকালের জন্য গেঁথে যাবে।
১৮ বছর ছুঁই ছুঁই চাঁদনী এই পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক। সাংবাদিক দলটির সংগ্রহ করে আনা প্রতিটি সংবাদকেই সে গভীর পর্যবেক্ষণ করে এবং এসব সংবাদের গুরুত্ব বোঝার জন্য সে যথেষ্ট জ্ঞান ধারণ করে। পত্রিকাটিতে তার ভূমিকাকেও সে দারুণ উপভোগ করে। আলোচনার মধ্য দিয়ে ক্ষুদে সাংবাদিকের দলটিকে সে সার্বক্ষনিক চাঙ্গা রাখে। সে তার রিপোর্টারদের প্রশিক্ষণও দেয়। রিপোর্টাররা সংবাদ সংগ্রহ করে আনলে বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে সেই সংবাদের মূখ্য ব্যপারটাকে সে বের করে নেয়। তার আত্মবিশ্বাসী এবং চির হাস্যোজ্জ্বল মুখটি তার অতীত ছিন্নমূল জীবনের গল্পকে লুকিয়ে রাখে।
মাত্র চার বছর বয়সেই তাকে নিয়ে তার পরিবার উত্তর প্রদেশের বেরেইলি থেকে দিল্লিতে চলে আসে। সে বয়সেই সে দিল্লির বিভিন্ন রাস্তায় তার বাবার সঙ্গে নাচতো, গাইতো ও শক্ত করে বাঁধা দড়ির উপর হেঁটে বেড়াতো। ২০০৮ সালে একটি স্ট্রোকে তার বাবা মারা যায়। তার তখন ১১ বছর বয়স। এসময় ট্রাফিক সিগনালে তোয়ালে এবং ফুল বিক্রি করা ছাড়া তার কাছে আর কোন পথ খোলা রইলো না। এসব করেই সে তার পরিবার চালাচ্ছিলো; ২০১০ সালে চিন্তা এনজিওটির স্বেচ্ছাসেবীদের চোখে পড়ার আগ পর্যন্ত। স্বেচ্ছোসেবীরা তাকে একটি উন্মুক্ত স্কুলে নিয়ে গেল এবং সেই স্কুলেই তাকে সাংবাদিকতার শিক্ষা দেওয়া হলো। তার কিছুদিন পরই সে বালকনামা পত্রিকায় যোগ দিলো। যার পর তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। মুখে একটি বড় হাসি ফুটিয়ে সে বলে, মানুষেরা একসময় আমাকে প্রত্যাখ্যান করতো, কেউ কেউ আমাকে দেখে বিরক্তিও প্রকাশ করতো। আর আজ আমি যখন একটি পত্রিকার সম্পাদক অনেক দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। আমার জীবন বদলে গেছে; বদলে যাচ্ছে আমার মতো আরও অনেকেরই। সম্প্রতি আমাকে বক্তৃতা দেয়ার জন্য টেডএক্স বেঙ্গালোর থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। স্বপ্ন সত্যি হলে যেমন হয়, এটাকে তেমনই মনে হচ্ছে। এমনটা চাঁদনীর একার গল্প নয়। পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত শানু, জ্যোতি, শম্ভুর মতো বাকী পথ শিশুদেরও রয়েছে এমন কাহিনী।
শানু ‘বালকনামা’ পত্রিকাটিতে এখন উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছে। সে একসময় একটি সমাধীক্ষেত্রে কাজ করতো। তার কপালে জুটতো কেবল দুপুর বেলায় আধ পেট ভাত। তার মদ্যপ বাবা পরিবারকে ত্যাগ করেছিলো। তাই মেয়ে হয়েও শানুকে স্কুল বাদ দিয়ে শিশুকালেই জীবিকার পথ ধরতে হয়েছিলো। সমাধীক্ষেত্রে কাজ করার সময়ই বাধে কদমের সংস্পর্শে এসে তার লেখালেখি করার ইচ্ছার পরিস্ফুরণ ঘটে। সেও একসময় বালকনামা’র প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছে। তারপর ১৮ বছর পূর্ন হলে সে নিয়মানুযায়ী চাঁদনীর কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছিলো। এখন উপদেষ্টা হিসেবে নতুন সাংবাদিকদের সে প্রশিক্ষণ দেয়।
নজরকাড়া হাসির জ্যোতি একসময় রাস্তায় তোয়ালে বিক্রি করতো এবং মাদকাসক্ত ছিলো। চাঁদনীর পর তাকেই প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হবে। কিভাবে আপনি বালকনামায় এলেন? এমন প্রশ্নে সুন্দর এক হাসি দিয়ে জ্যোতি জানায়, তার বাবা একজন মদ্যপ এবং যক্ষারোগী ছিলো। পরিবারকে সহযোগীতা করতে জ্যোতিকে একসময় নিজামউদ্দীন স্টেশনে ভিক্ষাবৃত্তিও করতে হয়েছে। স্টেশনটি তার বাড়ি থেকে দূরে হওয়ায় সে স্টেশনেই থাকতে শুরু করে। এসময় সে অন্য শিশুদের সংস্পর্শে এসে নষ্ট হতে শুরু করে। তারপর সেও একদিন বাধে কদমের সহযোগীদের নজরে পড়ে। এরপর সে বিভিন্ন শিক্ষামূলক কর্মকা-ের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে শুরু করে। সে নাচতে ভালোবাসে। একসময় সে সব খারাপ কাজ ছেড়ে দেয়। বাধে কদমের দলের সদস্যরা তাকে দেরাদুনের একটি আবাসিক প্রশিক্ষণালয়ে নিয়ে যায়। সেখান থেকে ফিরেই সে দক্ষিণ দিল্লিতে বাধে কদমের সংগঠনের নেতৃত্ব দেয়া শুরু করে। তখন থেকেই তার ছবি ও সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করে। চাঁদনীর স্থালাভিষিক্ত হবে সেই-ই।
শম্ভু দারুণ প্রতিভাবান এক বালক; যে পড়তে ভীষন ভালোবাসে। একসময় অবশ্য সে বাসস্টপে দাঁড়িয়ে ফল বিক্রি করতো। তারপর সে একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করতো যেখানে তাকে প্রায়ই মারধোর করা হতো। চিন্তা এনজিওটির সংস্পর্শে আসার আগ পর্যন্ত সে সেখানেই কাজ করতো। সে দশম শ্রেনীর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। সকালবেলায় রাস্তার শিশুদের কাছ থেকে সে সংবাদ সংগ্রহ করে আর সন্ধ্যায় গাড়ি ধোয়ার একটি কাজ করেই তার সংসারকে সহযোগীতা করে। চাঁদনী খুব গর্বিত মেজাজে সেরা রিপোর্টার হিসেবে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়।
বালকনামার ক্ষুদে সাংবাদিকরা কেবল একটি পত্রিকাই প্রকাশ করছেনা। তারা সমাজের এমন একটি পরিবর্তন আনছে, যা আমাদের কেউ কেউ কেবল ভাবনায় সীমাবদ্ধ রেখেছি। অনেক রিপোর্ট করতে গিয়ে এসব সাংবাদিক প্রাণনাশেরও হুমকি পায়। তবে এসব তারা থোরাই পরোয়া করে। লজিক্যাল ইন্ডিয়ান থেকে অনুবাদ