পাহাড়ি তরুণীদের বাঙালির সঙ্গে সম্পর্কের শাস্তি ‘গণধর্ষণ’
মমিনুল ইসলাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ফিরে : পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি তরুণীরা প্রেমিক বা স্বামী হিসেবে পছন্দ করে বাঙালি যুবকদের। আমাদের সংবিধানও আন্তঃধর্মীয় বিয়ের অনেক ক্ষেত্রে কোনো বাধা প্রদান করে না। কিন্তু এ আইনের তোয়াক্কা করে না পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো। কোনো পাহাড়ি তরুণী কোনো বাঙালি যুবককে বিয়ে বা তার সঙ্গে মেলামেশা করলে ভোগ করতে হয় করুণ পরিণতি। শাস্তি স্বরূপ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিকার হতে হয় অপহরণ, দল বেধে যৌন নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপ ও হত্যার।
তবে এবার কোনো প্রেম-ভালবাসা নয়। কেবল কলেজ ভর্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করতে এক বাঙালির দোকানে যাওয়ায় এক চাকমা কিশোরীকে প্রকাশ্যে মারধর করেছে পাহাড়ের একটি ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। শুধু এখানেই শেষ নয়। পরে এ কিশোরীকে নেওয়া হয় পাহাড়ের গহীন জঙ্গলে। দল বেঁধে করা হয় যৌন নির্যাতন। এ বর্বর মুহূর্তের দৃশ্যও ধারণ করা হয় মোবাইলে। ঘটনাটি ঘটেছে রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলায় গেল ২৯ মে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর করা মামলায় সুনীতিময় চাকমা (৩০) নামে এক পিসিপি নেতাকে ১৪ জুন আটক করে জেল হাজতে পাঠিয়েছে পুলিশ। সে উপজেলা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (সন্তু লারমা) অর্থ সম্পাদক।
১৭ বছর বয়সী ওই চাকমা কিশোরী রাঙামাটি কোতোয়ালি থানার ধুল্লাছড়ি গ্রামের সুনীল কান্তি চাকমার মেয়ে। এ ঘটনায় মামলার পর ভুক্তভোগীকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১৪ জুন আটকের পর পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন সুনীতিময়। আটকের পর তাকে শনাক্ত করেছে ভুক্তভোগী।
ভুক্তভোগী ও মামলা সূত্রে জানা যায়, চাকমা কিশোরী এ বছর এসএসসি পাস করেছে। উচ্চ মাধ্যমিকে অনলাইনে আবেদনের জন্য গত ২৯ মে বিলাইছড়ি বাজারের শিহাবের কম্পিউটারের দোকানে যায় সে। এ সময় স্থানীয় সুনীতিময় চাকমাসহ ১৫ থেকে ২০ জন পাহাড়ি দোকানের মধ্যেই আটকে ফেলে তাকে। বাঙালি ছেলের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক আছে দাবি করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে নিয়ে প্রকাশ্যে মারধর করা হয়।
পরে তাকে অপহরণ করে কেরণছড়ির অজ্ঞাত জঙ্গলে নিয়ে যায় পিসিপি কর্মীরা। সেখানে তাকে পুনরায় মারধর ও গালিগালাজ করে। অতঃপর তার চোখ বেঁধে যৌন হয়রানি করা হয়। এ ঘটনা কাউকে জানালে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে মা সহকারে গাছকাটা ছড়া আর্মি ক্যাম্পে উপস্থিত হয়ে ঘটনার বর্ণনা দেয় চাকমা যুবকদের নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়া মেয়েটি। এ সময় মেয়েটির শরীরের কিছু অংশ রক্তাক্ত দেখে সেনাবাহিনীর সদস্যরা পুলিশকে খবর দেয়। পরে মেয়েটি বাদী হয়ে বিলাইছড়ি থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৭/১০/১৩ ধারায় একটি মামলা দায়ের করে। মামলা নং ১/৫/১৬।
এদিকে এ ঘটনায় আটক পিসিপি নেতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তার গ্রেফতারের প্রতিবাদে দুদিন হরতাল পালন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (সন্তু গ্রুপ)। গেল ১৫ ও ১৬ জুন বিলাইছড়ি উপজেলায় এ হরতাল পালন করা হয়।
গত ২১ জুন বিলাইছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মঞ্জুরুল আলম মোল্লা মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। জানান, আটক পিসিপি নেতার বিরুদ্ধে শিগগিরই রিমান্ড আবেদন করা হবে। বাকিদের আটকের চেষ্টা চলছে।
মা মোবাইল সেন্টারের মালিক শিহাব জানান, তার স্ত্রী-সন্তান রয়েছে। ওই চাকমা কিশোরীর সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই। তার মতো অনেক পাহাড়ি মেয়েই তার দোকানে নিয়মিত আসত। এ ঘটনা ২৯ মে ঘটলেও ১৪ জুন পিসিপি নেতা আটক হওয়ার পর দোকান বন্ধ করতে বাধ্য হন শিহাব। তার জমাদার সুশীল চাকমা জানান, অসামাজিক কার্যকলাপের বিষয়টি তিনি নিজে না দেখলেও তাকে আর দোকান ভাড়া দেবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এদিকে গত ২২ জুন বুধবার রাঙামাটি রিজার্ভ বাজার বাস স্টেশন মোড়ে ‘ধর্ষকদের’ দ্রুত গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন পার্বত্য বাঙালি ছাত্রঐক্য পরিষদ। এ সময় বক্তারা অভিযোগ করেন, সন্তু লারমার মদদে জেএসএস ও পিসিপি পাহাড়ে চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ ও জাতি বিদ্বেষী কর্মকা- পরিচালনা করছে।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, এর আগে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে ভালবেসে এক বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করার অপরাধে খাগড়াছড়ির গুইমারার উমাচিং মারমা (১৮) নামে এক মারমা তরুণী ও তার পরিবারকে নির্যাতন ভোগসহ মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়। তাকে একটি কক্ষে বেঁধে অমানসিক নির্যাতন করা হয়।
২০১৫ সালের শুরুর দিকে ভালবেসে চাকমা মেয়েকে বিয়ে করাই কাল হয় প্রথম আলোর সাবেক স্টাফ আলোকচিত্র সাংবাদিক সৈকত ভদ্রের। অপরদিকে ভালবাসার মানুষকে ভুলে যেতে স্ত্রী রেটিনা চাকমার উপর চলে মধ্যযুগীয় বর্বরতা। তোলা হয় নিলামে। যা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে গণমাধ্যমে।
সবচেয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করা ঘটনা ঘটে গত বছরের এপ্রিলে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালায়। উপজেলার ক্ষেত্রলাল ত্রিপুরার মেয়ে দীপা ত্রিপুরা (১৮) ভালবেসে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিল চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার আহমদ কবীরের ছেলে মো. আবদুল হান্নানের (২৪) সাথে। এ সময় প্রেমিক হান্নানের হাত ধরে পালানোর সময় বাস থেকে থামিয়ে দীপা ত্রিপুরা ও হান্নানকে অপহরণ করে পিসিপির কর্মীরা।
অপহরণের পর একটি ঝুম ঘরে আটক করে দীপা ত্রিপুরাকে পালাক্রমে গণধর্ষণ করে পিসিপির স্থানীয় কয়েকজন নেতাকর্মী। গণধর্ষণের পর গভীর রাত পর্যন্ত দীপা ত্রিপুরাকে নিয়ে উল্লাস করে এসব সন্ত্রাসীরা। পুরো গণধর্ষণের দৃশ্য মোবাইলে ভিডিও করা হয়। এ ঘটনায় আটক ইউপিডিএফ সমর্থিত পিসিপির নেতা সজীব ত্রিপুরা (২২) প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানায়।
এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি মুসলিম ছেলেকে ভালবেসে মাটিরাঙার সোনাবি চাকমা, রাঙামাটির কুতুকছড়িতে রিনা ত্রিপুরা, রামগড়ের মণিকা ত্রিপুরাসহ এরকম আরও অসংখ্য পাহাড়ি মেয়েকে অপহরণ, ধর্ষণ, হত্যাসহ বিভিন্ন নারকীয় অভিজ্ঞতার শিকার হতে হয়েছে।
সম্প্রতি পাহাড়ি তরুণীদের নিজ জাতি-গোষ্ঠীর লোকদের হাতে এরূপ নির্বিচারে গণধর্ষণের শিকার হওয়া নিয়ে গবেষণাধর্মী উপন্যাস বের করেন লেখিকা রোকেয়া লিটা। চলতি বছরের শুরুর দিকে ‘ডুমুরের ফুল’ নামে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এ বইটি বের করলে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয় তাকে।
রাঙামাটির বিলাইছড়ির কেরণছড়ি মৌজা কার্বারী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অংচাখই কার্বারী জানান, কোনো পাহাড়ি মেয়ে বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করলে উপজাতিদের সামাজিক নিয়মে কোনো শাস্তির বিধান নেই। তবে আমরা এ ক্ষেত্রে কার্বারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সাধারণত ২০ হাজার টাকা জরিমানা করে থাকি। এরপর তাদের একত্রে বসবাসে সমস্যা নেই। সম্পাদনা : রাশিদ রিয়াজ