অপরাধী হলে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই
ইকতেদার আহমেদ
প্রথম আলো পত্রিকায় গত ২৮ জুন, ২০১৬ খ্রি. ‘বাবুল চাকরিতে ফিরছেন না’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সূত্রকে উদ্ধৃত করে দাবি করা হয়, ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসা করাকালীন বাবুল আক্তারকে দুটি শর্ত দিয়ে বলা হয়Ñ কর্তৃপক্ষের নিকট ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা বিষয়ে সকল তথ্য প্রমাণ রয়েছে। আর তাই, হয় তাকে জেলে যেতে হবে অথবা বাহিনী থেকে সরে যেতে হবে। সূত্রকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, বাবুল আক্তার বাহিনী ছেড়ে চলে যেতে সম্মত হয়েছে।
উল্লেখিত শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়নি। আইন সম্পর্কে জ্ঞাত পুলিশ বিভাগে কর্মরত এমন কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিজ নামে বা নাম না প্রকাশ করার শর্তে এমন কথা বলতে পারেন এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী যেকোনো ব্যক্তি অপরাধ সংগঠন করলে এর দায় তার ওপর বর্তায়। আর অপরাধটি হত্যাকা-ের ন্যায় বড় মাপের অপরাধ হলে এটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। এরূপ অপরাধের বিচারের দায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করে। তাছাড়া বিচার পূর্ববর্তী তদন্ত রাষ্ট্রীয় সংস্থাকর্তৃক পরিচালিত হয় এবং বিচার চলাকালীন রাষ্ট্রকর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবী রাষ্ট্রের পক্ষে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব বহন করে।
আমাদের সংবিধানের অনন্য বৈশিষ্ট্য আইনের দৃষ্টিতে সমতা। এটি দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এ বৈশিষ্ট্যটির মর্মানুযায়ী একজন অপরাধীর অবস্থান ও মর্যাাদা যাই হোক না কেন, আইন সকল অপরাধীর ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। সুতরাং একজন অপরাধী কৃষক, শ্রমিক বা রিকশাচালক হলে আইন যেভাবে এদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে অনুরূপ একজন অপরাধী প্রশাসক, বিচারক, সেনা কর্মকর্তা বা পুলিশ কর্মকর্তা হলেও আইন সমভাবে তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। আইনের দৃষ্টিতে সমতা এ অনন্য বৈশিষ্ট্যটির কারণেই দেখা যায়, একই অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির একই আদালতে এবং একই আইনে আইনগত সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতঃ বিচার কার্য সমাধা করা হয়।
বাংলাদেশে ইতোপূর্বে দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমান হত্যা মামলায় অপরাধীগণ সেনাবাহিনীতে কর্মকর্তা পদে নিয়োজিত ছিল এবং এদের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধাও ছিল। কিন্তু বিচারের ক্ষেত্রে তাদের কাউকে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হয়নি। মেজর জেনারেল মঞ্জু হত্যা মামলায় একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে বিচারের সম্মুখীন এবং বিচারকার্য স্বচ্ছভাবে পরিচালিত হলে তার পরিণতি কি হবে এ বিষয়টি এ দেশের সচেতন জনমানুষ অনুধাবন করতে সক্ষম। যেকোনো অন্যায় বা অপরাধের বিচার রাজনৈতিক কারণে অথবা কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে সঠিকভাবে করা না হলে প্রকৃতি এর প্রতিশোধ গ্রহণ করে এবং প্রকৃতির প্রতিশোধ সবসময় নির্মম ও কঠিন হয়ে থাকে।
পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা পরবর্তী কর্তৃপক্ষের পক্ষ হতে প্রথমতঃ জঙ্গিদের এবং অতঃপর বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করা হয়েছিল। এরপর বলা হলো, পেশাদার অপরাধীরা একজন প্রভাবশালীর নির্দেশনায় হত্যাকা-টি সংগঠিত করেছেন, যদিও এখন পর্যন্ত প্রভাবশালীর নাম ব্যক্ত করা হয়নি। ইতোমধ্যে দুজন গ্রেফতারকৃত অপরাধী ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট ১৬৪ ধারায় যে জবানবন্দি দিয়েছেন তা অসমর্থিতভাবে যেভাবে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাতে জানা যায়, তারা উভয়ে নিজেদের বিজড়িত করে জবানবন্দি দিয়েছেন। এ ধরনের জবানবন্দি বিচারিক আদালতে তাদের বিরুদ্ধে ভালো সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত। এ ধরনের সাক্ষ্য অপর কোনো সহায়ক সাক্ষ্য ব্যতিরেকেই গ্রহণযোগ্য। উপরোক্ত দুজন বা অপর কেউ ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে যদি তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে বিজড়িত করে সাক্ষ্য দেয়, সেক্ষেত্রে এ সাক্ষ্য অপর কোনো সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত না হলে তা গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হওয়ার অবকাশ নেই।
বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যা মামলায় বাবুল আক্তার স্বয়ং বাদী। হত্যা পরবর্তী স্ত্রীর মৃতদেহের সম্মুখে এবং স্ত্রীর জানাজা পড়াকালীন তাকে যেভাবে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত দেখা গেছে, এটি বিবেচনায় নেওয়া হলে তার ব্যাপারে ভিন্নতর কোনো অবস্থান গ্রহণের সুযোগ ক্ষীণ।
পুলিশের একটি নাম না প্রকাশ করার শর্তের উদ্বৃতি দিয়ে দু’একটি সংবাদ মাধ্যমে দাবি করা হয়, স্ত্রীর পরকিয়ার কারণে তার স্বামী নেপথ্যে থেকে ঘটনাটি সংগঠিত করিয়েছেন। বর্তমানে পুলিশ কর্মকর্তাদের হাতে যেভাবে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে সেটিকে বিবেচনায় নেওয়া হলে, একজন ব্যবসায়ী পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীর সঙ্গে পরকিয়ায় লিপ্ত হওয়ার সাহস দেখাবেন এটি বিশ্বাস করার মতো কোনো সঙ্গত কারণ নেই।
মামলাটি তদন্তে বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যার সঙ্গে কোনো সংশ্লেষ প্রমাণিত হলে এর একমাত্র বিকল্প হলো তাকে অপরাধী গণ্যে বিচারের সম্মুখীন করা। আর তার যদি কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা না থাকে সেক্ষেত্রে প্রথমতঃ তাকে বিচারের সম্মুখীন করার সুযোগ নেই এবং দ্বিতীয়তঃ বাহিনী ছেড়ে চলে যেতে বলারও সুযোগ নেই। সুতরাং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে প্রকাশিত সংবাদ দেশের সংবিধান ও বিদ্যমান আইনের আওতায় কোনো ধরনের ছাড় দেওয়ার অবকাশ সৃষ্টি করে না। এরপরও যদি সূত্রের কথিত মতে তার ক্ষেত্রে উপরোক্ত দুটির শেষোক্তটি কার্যকর করা হয়, সেক্ষেত্রে এটি দেশের প্রচলিত আইন দ্বারা অনুমোদিত নয় এমন একধরনের ছাড় যা ভবিষ্যতের জন্য খারাপ দৃষ্টান্তের জন্ম দিবে।
লেখক : সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন