মেসিম্যানিয়া
ট্র্যাজেডি ছাড়া বীর হওয়া যায় না। ফুটবল ট্রয়ের হেক্টররূপী মেসি, ফুটবল দেবতাদের হাজারো পরীক্ষায় জর্জরিত হারকিউলিসরূপী মেসি যেন ল্যাটিন ফুটবলকে ‘বিদায় বন্ধু’ বলে আরেকবার তার ম্যাজিক রিয়েলিজমের নমুনা দেখালেন।
’৮৬ বিশ্বকাপ জয়ী আর্জেন্টাইন ভালদানো বলেছিলেন, ‘সেই মেক্সিকো বিশ্বকাপের পর হতে মেসি আমাদের প্রতিদিনের ম্যারাডোনা। ২০১৫ তে কোপা জয়ী চিলির কোচ সাম্পোলি সেদিন বলেছিলেন, ‘আমার ধারণা যারা বোঝে না, মেসি সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার, তারাই সেরা বোকা।’ এবারের কোপা জয়ী চিলির কোচ পিজ্জি বলেন, ‘প্রত্যেকের ভিন্নমত থাকতে পারে, কিন্তু আমার মতে মেসির চেয়ে ভালো ফুটবলার আর জন্মায়নি।’
যে যাই বলুক, মেসি এই মুহূর্তে কি ভাবছেন সেটা বিবেচ্য বিষয়। ফুটবলিং নিয়ে মেসির ‘স্কুল অব থট’ তা ভিন্ন। অন্য দলের মূল খেলোয়াড়রাই সচরাচর পেনাল্টিতে শেষ শটটা নিয়ে থাকেন। শেষ বলে জালে বল জড়িয়ে ‘হিরো’ হতে কে না চায়? মেসির চিন্তাধারা সে ক্ষেত্রে ভিন্ন। আপাদমস্তক দলের চিন্তাটাই তার বেশি। চিলির সঙ্গে প্রথম বলে পেনাল্টি শট নিতে চাওয়াটা অনেককেই অবাক করলে যারা মেসিকে চেনেন তাদের জন্য এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। দলের নেতৃত্ব নিতে চাইবার ব্যাপারটা মেসির মধ্যে অনেক বেশি নিঃশব্দে কাজ করে। পারফরমেন্সটাই সেখানে মূখ্য। হাত পা নাড়িয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে সহ-খেলোয়াড়দের উত্তেজিত করে কিছু আদায় করাটা মেসির ধাতে নেই। বার্সেলোনায় মেসি স্বেচ্ছায় সুয়ারেজের জন্য জায়গা ছেড়ে দেন, যেন মূল স্ট্রাইকার হিসেবে সুয়ারেজের গোল পেতে সমস্যা না হয়। লুইস এনরিক এ জন্য সবসময় মেসিকে ধন্যবাদ দেন। একই কাজ কিন্তু কোনো দলের আরেকজন লিডিং স্কোরার করবে না। মেসি একাধারে পুরো মাঠজুড়ে খেলতে ও গোল করতে ভালোবাসেন। যদিও ডানপ্রান্ত ঘেঁষে মাঝ বরাবর বল নিয়ে দৌড়ানোই তার প্রথম পছন্দ, কিন্তু দলের প্রয়োজনে নিজের পছন্দ ঝেড়ে ফেলে প্রয়োজনে অনেক নিচে নেমেও মেসিকে খেলতে দেখা গেছে।
সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস সবার থাকে না। মেসি স্রেফ খেলতে ভালোবাসেন। জাতীয় দলে খেলার প্রসার অনেক আলাদা। ম্যারাডোনার পাসে বুরুচাগা ’৮৬ তে গোলটা দিতে না পারলে তখনও আর্জেন্টিনা হেরে যেত হয়তো। কিংবা ৯০-এর বিশ্বকাপে তার পাসে ব্রাজিলের বিপক্ষে ক্যানিজিয়ার করা সেই চোখে লাগা গোল। কিন্তু মেসির বাড়ানো পাস হিগুয়েন, আগুয়েরারা গোলে রূপান্তর করতে না পারার খেসারত কিন্তু দিতে হচ্ছে গত তিন ফাইনালে এককভাবে মেসিকেই। পেনাল্টি মিস করা স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেক গ্রেটরাই করেছেন। আধুনিক ফুটবলের প্রেসার এখন বহুমুখী। মেসি বুঝে গেছেন, এই দল বা ব্যবস্থাপনা তার জন্য না। তিনি যদি মোৎসার্ট হন তবে বাকিরা বড় জোর আনু মালিক! খেলার রাজা বা শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় তকমা লাগানোর অহঙ্কারী দৌড়ে মেসি নেই।
আর্জেন্টিনার জনগণের মানসিক সমস্যাটা অন্য জায়গায়। আরও স্পষ্ট করে বললে, দেখা গেছে আর্জেন্টিনার মিডিয়া সেদেশের একজন ভালো ফুটবলারের কাঁধে পাহাড় প্রমাণ প্রত্যাশা চাপিয়ে তার সহজাত কাজকে আরও দুরূহ করে তোলে। ক্রমাগত শিরোপা খরা আর্জেন্টিনার জনগণকে আরও অনমনীয় ও অবিবেচক করে তোলে। সেই ১৯৯০-এর ব্যর্থতার পর তারা সব সময় আরেকজন ম্যারাডোনাকে খুঁজে এসেছে। সেই চাপটা নিতে না পেরে গত ২০ বছরে অনেক ভালো ফুটবলার বিষণœতায় ভুগেছেন। ওর্তেগা, আইমার, তেভেজ, ক্রেসপো, রিকুয়েলম হতে শুরু করে নামের লিস্টটা অনেক দীর্ঘ। অথচ পর্তুগালের রোনালদোর ওপর ইউসোবিও, নেইমারের ওপর পেলে কিংবা রুনির ওপর ববি চার্লটন হবার কোনো চাপ নেই। কিন্তু মেসিকে খেলার মাঠে বারবার বার্সেলোনা ও অর্জেন্টিনার হয়ে গোল ও রেকর্ড গড়ে প্রমাণ করতে হয়েছে ফুটবলার হিসেবে তার অনন্যতা আর সবার চেয়ে ভিন্ন। শুধু বিশ্বকাপ ও দেশের পক্ষে শিরোপা জেতা ছাড়া মেসি কিছুই বাদ রাখেননি। কিন্তু এখনও আর্জেন্টাইনরা ম্যারাডোনার মধ্যে বুনো, বদরাগী, মিথ্যুক, প্রতারণায় পারদর্শী, অবিবেচক, স্বেচ্ছাচারী একজন ফুটবল ঈশ্বরকে অবচেতনভাবে খুঁজে ফেরেন। শান্তশিষ্ট মেসি তার চেয়ে অনেক আলাদা। তুলনাটাও তাই এক্ষেত্রে হাস্যকর। মেসিকে ফুটবলের মোৎসার্ট বলে মেনে নেওয়াটাও তাই অনেক কম ভাবা হয়। শেষ খবরে জানলাম, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট মেসিকে তার সিদ্ধান্ত বদলের অনুরোধ করেছেন এবং বার্তায় উল্লেখ করেন, মেসির টিম তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে এবং তিনি মেসির মতো ফুটবলারের জন্য গর্বিত।
মেসিকে যিনি মনে মনে ও প্রকাশ্যে হিংসে করেন সেই কিংবদন্তী ম্যারাডোনাও মেসিকে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে আশা প্রকাশ করেছেন মস্কোর ফাইনালে মেসিই চ্যাম্পিয়ন হবে। মেসি জানেন তার এই ফিরে আসার অর্থ হলো, আবারও প্রত্যাশার চাপ বাম পায়ে নেওয়া। আর চলে যাওয়ার মানে হলো, এক বিশ্বসেরা ট্র্যাজিক ফুটবলারের অসময়ে প্রস্থান, ভাগ্যদেবী যার সহায় ছিল না।
কি করবেন মেসি?
লেখক : চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন