উপজাতি চাঁদাবাজদের স্বর্গরাজ্য পাহাড়ি জনপদ
মমিনুল ইসলাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ফিরে : চাঁদাবাজির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এক-দশমাংশের পার্বত্য জনপদ। সরকারি কর বা ভ্যাটের ন্যায় এখানে প্রকাশ্যে চলছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি, এমনটিই জানিয়েছে গোয়েন্দা সূত্র। বাঙালি-পাহাড়ি যেই হোক না কেন, কিছু করতে হলেই গুণতে হয় চাঁদা। উপজাতিদের সশস্ত্র গ্রুপগুলো চাঁদাবাজির মাধ্যমে দিনে আদায় করে এক থেকে দেড় কোটি টাকা। সামান্য কলার ছড়া থেকে শুরু করে, ব্যবসা-বাণিজ্য, জেলে, খামার, ঠিকাদারি, উন্নয়নমূলক কাজÑ সবকিছু থেকে আদায় করা হয় চাঁদা। আর তা না দিলে নির্যাতন, নিপীড়ন থেকে শুরু করে অপহরণ, খুন, ধর্ষণ হওয়ার শঙ্কা ভুক্তভোগীদের। প্রাণ ভয়ে মুখও খুলতে চান না তারা। স্বয়ং পুলিশ প্রশাসনও তাদের কাছে জিম্মি বলে অভিযোগ।
একটি গোয়েন্দা সূত্র বলছে, পুরো পার্বত্য অঞ্চলে (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) চাঁদা আদায়ে নিয়োজিত রয়েছে জেএসএস’র-ইউপিডিএফর পাঁচ হাজার সশস্ত্র প্রশিক্ষিত কর্মী। সরকারের করের ন্যায় বিভিন্ন জিনিসের ওপর মাসিক/বার্ষিক নির্দিষ্ট হারে চাঁদা আদায় করা হয় এবং রসিদও দেওয়া হয়। ক্যাডার পর্যায়ে নিয়োগপ্রাপ্ত এসব সশস্ত্র সদস্যের বেতন-ভাতাও দেওয়া হয় বলে জানিয়েছে সূত্র।
সম্প্রতি পাহাড়ে বিভিন্ন পণ্যের ওপর ‘শান্তি চুক্তি’ সমর্থক জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও চুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফর আরোপ করা চাঁদার তালিকা করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এতে সাবেক ও বর্তমান রেটও উল্লেখ করা হয়েছে।
এ তালিকা মতে, গাছে প্রতি ঘনফুট ও বাঁশে প্রতিশ হিসেবে চাঁদা আদায় করা হয়। বর্তমানে প্রতি ঘনফুট সেগুন গোল গাছে জেএসএসকে চাঁদা দিতে হয় বছরে ৪০ টাকা, ইউপিডিএফকে দিতে হয় ৫০ টাকা। এভাবে সেগুন রদ্দা, গামারী গোল-রদ্দা, লালি গোল-রদ্দার ওপর আলাদা আলাদা হারে চাঁদা ধার্য করা হয়েছে।
বর্তমানে প্রতিশ বাঁশে বছরে জেএসএস-ইউপিডিএফ উভয়েই চাঁদা আদায় করে ৪০০ টাকা করে। এভাবে বাইজ্জা বাঁশের জন্য রয়েছে আলাদা রেট। প্রথম শ্রেণির মাছ ব্যবসায়ীদের জেএসএসকে বছরে চাঁদা দিতে হয় ৪০ হাজার, ইউপিডিএফকে ৫০ হাজার। এভাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির ব্যবসায়ীদের পৃথক হারে গুণতে হয় চাঁদা।
তালিকা থেকে আরও জানা যায়, বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরার জালের ওপর আলাদা আলাদা হারে বার্ষিক (নয় মাসে বছর) চাঁদা আদায় করা হয়। কেসকি জাল (১ হাজার বামের ওপর) থেকে জেএসএস আদায় করে ছয় হাজার টাকা, ইউপিডিএফ সাত হাজার। এভাবে ধর্ম জাল, টেংরা জাল, কুত্তা জাল, ভাসা জাল, টেইনা জাল, লুই জাল, নাইট জাল, বড়শির ওপর আলাদা হারে চাঁদা আদায় করে তারা। এছাড়া সব ধরনের জেলেদের বছরে চাঁদা দিতে হয় জেএসএসকে সাতশ, ইউপিডিএফকে পাঁচশ।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতি বাসিন্দাদেরও দিতে হয় বার্ষিক চাঁদা। প্রতি উচ্চবিত্ত পরিবারের জন্য জেএসএস- ইউপিডিএফর ধার্যকৃত চাঁদা আটশ টাকা। মধ্যবিত্ত পরিবার প্রতি জেএসএস আদায় করে পাঁচশ এবং ইউপিডিএফ ছয়শ। নিম্নবিত্ত পরিবার প্রতি জেএসএস তিনশ, ইউপিডিএফ চারশ টাকা চাঁদা আদায় করে।
এ চাঁদার আওতায় বাদ পড়েনি কলার ছড়াও। প্রতি ছড়ার জন্য বর্তমানে জেএসএসকে ছয় টাকা ও ইউপিডিএফকে দিতে হয় ১০ টাকা। এছাড়া গরু ও ছাগল বিক্রির ওপর যথাক্রমে জেএসএস ১২ ও ৬ শতাংশ এবং ইউপিডিএফ দুইশ ও একশ হারে চাঁদা আদায় করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো চাঁদার এ অর্থ দিয়ে দেশ-বিদেশে বাঙালি বিদ্বেষী প্রচারণা ও তাদের অস্ত্র ভা-ারকে সমৃদ্ধ করার কাজ করে থাকে।
বার্ষিক এ চাঁদা আদায় ছাড়াও বিভিন্ন দিবসকে সামনে রেখে বেপরোয়া চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে ইউপিডিএফ-জেএসএসসহ আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে। প্রতি বছর ‘বৈসাবি’ উদযাপন কমিটির নামে ব্যক্তিবিশেষে দুই হাজার টাকা থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্তও চাঁদা আদায় হয়।
ইনকিলাব-এ প্রকাশিত খবরের তথ্য অনুযায়ী, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে চাঁদাবাজির শীর্ষে রয়েছে শান্তিচুক্তিবিরোধী সংগঠন ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এর পরের অবস্থানে রয়েছে চুক্তির সমর্থক পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ক্যাডাররা। এদের অঙ্গ সংগঠন যেমন- পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল উইম্যান ফেডারেশন বিভিন্ন অপকৌশলে পাহাড়ে চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে।
পাহাড়ের নিরীহ বাঙালিরাই মূলত সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির প্রধান টার্গেট। এর পরের অবস্থানে রয়েছে তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসরত ১৩টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। এর মধ্যে প্রায় সকলকে চাঁদা দিতে বাধ্য হতে হলেও চাকমাদের কাছ থেকে চাঁদা দাবির তেমন ঘটনা শোনা যায় না।
স্থানীয়রা জানান, বাঁশ, বেত, কাঠ, ছন সংগ্রহ, বেচাকেনা ও পরিবহন, কৃষি-খামার, ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসা-বাণিজ্য, সড়ক ও নৌপথে মালামাল পরিবহন থেকে শুরু করে ঠিকাদারি, অবকাঠামো নির্মাণ কাজÑ সবকিছুর ওপর থেকেই জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এমনকি কলা, আদা, হলুদ, আনারস, লেবু, কমলা, খাদ্যশস্য চাষাবাদ, গবাদিপশু-পাখি বেচাকেনা করতে গিয়েও চাঁদা পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছেন পার্বত্য এলাকার বাসিন্দারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা জানান, এখানে অস্ত্রধারী জেএসএসের এতটাই প্রভাব ক্ষমতাসীন দলের লোক হয়েও তাদের পক্ষে চাঁদাছাড়া বসবাস করা অসম্ভব। নিরুপায় হয়ে দোকান-পাটও গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। তাদের কাছে পুলিশও জিম্মি বলে অভিযোগ তার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তর বন বিভাগের বাঘাইহাট রেঞ্জের এক বন কর্মকর্তা জানান, রাঙামাটিতে সাধারণ সরকার ছাড়াও অন্য একটি ‘সরকার’ কাজ করে। যেটাকে তারা কখনই উপেক্ষা করতে পারেন না। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও অবহিত বলে জানান তিনি।
২২ জুন পার্বত্য চট্টগ্রামের সংরক্ষিত মহিলা এমপি ফিরোজা বেগম চিনু বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শান্তিচুক্তি করে পাহাড়ে অনেক উন্নয়ন করেছেন। কিন্তু কিছু সশস্ত্র গ্রুপ চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ করে পাহাড়কে অস্থিতীশীল করার পাঁয়তারা করছে। তিনি এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন বলে জানান।
জেএসএসর মুখপাত্র ও সহপ্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা আমাদের সময় ডটকমকে বলেন, ‘জেএসএস’র বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমরা চাঁদাবাজিতে বিশ্বাসী নই। মানুষের সহযোগিতায় দল পরিচালিত হয়।’
অন্যদিকে, ইউপিডিএফর মুখপাত্র, প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগের প্রধান নিরন চাকমা চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করেন। বলেন, ‘এ অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। তিনিও জানান, মানুষের সহযোগিতায় তাদের দল পরিচালিত হয়। সম্পাদনা : রাশিদ রিয়াজ