নিহত ৪১, আহত ২৩৯ তুরস্কের আতাতুর্ক বিমানবন্দরে জঙ্গি হামলা
ইমরুল শাহেদ : গত মঙ্গলবার রাত ১০টা। আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক বিমানবন্দর। তিনজন সশস্ত্র জঙ্গি হঠাৎই বিমানবন্দরের যাত্রীদের উপর নির্বিচারে গুলি ও বোমা ছুঁড়তে থাকে। পাল্টা গুলি চালায় বিমানবন্দরের নিরাপত্তারক্ষীরাও। এই হামলা ও পাল্টা হামলায় অকুস্থলেই নিহত হয়েছেন ৪১ জন।
এছাড়া, ২৩৯ জন আহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ছয়জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আহত ২৩৯ জনের মধ্যে ১০৯ জন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। নিহত ৪১ জনের মধ্যে ৩৭ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ১৪ জন বিদেশি এবং তিনজন দ্বৈত নাগরিক। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে একজন আছেন ইউক্রেনীয়। প্যালেস্টাইনী কর্তৃপক্ষের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এর মধ্যে একজন প্যালেস্টাইনী নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন আরও পাঁচ জন। সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে ছয় জন হলেন সৌদি নাগরিক। দেশটির আরও ২৭ জন আহত হয়েছেন। তুরস্ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নিহত বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে একজন তিউনিশিয়ান, দুইজন ইরাকী, একজন চীনা, একজন ইরানী, একজন জর্ডানী ও একজন উজবেকিস্তানের নাগরিক রয়েছেন। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পার্।ে
তুরস্কের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার রাতে তিন বন্দুকধারী ইস্তাম্বুল আতাতুর্ক বিমানবন্দরের প্রধান ফটকের কাছে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এ সময় সেখানে থাকা ব্যক্তিরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পালানোর চেষ্টা করেন। পরে পুলিশ বন্দুকধারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লে তারা আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়। হামলার পরে বিমানবন্দরের সবক’টি গেটই সিল করে দেওয়া হয়। তুরস্কের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক টার্মিনালের প্রবেশ পথের কাছে পুলিশকে লক্ষ্য করেও গুলি চালিয়েছিল জঙ্গিরা। তবে রক্ষীদের পাল্টা জবাবে তারা কেউই আন্তর্জাতিক টার্মিনালের ভিতরে ঢুকতে পারেনি। প্রত্যক্ষদর্শীদের কারও কারও বর্ণনানুযায়ী, জঙ্গিদের মধ্যে একজন পালিয়ে গিয়েছে। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি জানিয়েছেন, তদন্ত শুরু হয়েছে। কোনো জঙ্গি লুকিয়ে রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। চলছে চিরুনী তল্লাশি।
চলতি বছরে এই নিয়ে চারটি জঙ্গি হামলার সাক্ষী হয়ে থাকল তুরস্ক। বছরের প্রথমদিকে আইএস হামলায় কেঁপে উঠেছিল ইস্তাম্বুল। দ্বিতীয় হামলাটি হয়েছিল রাজধানী আঙ্কারায়। মৃত্যু হয়েছিল ২৮ জনের। এর পর আবারও আঙ্কারায় গাড়ি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল জঙ্গিরা।
দেশটির রাষ্ট্রপতি রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের সন্ধিক্ষণে এই হামলা হলো। ইস্তাম্বুলের মতো পৃথিবীর যেকোনো বিমানবন্দরে বা শহরে এ ধরনের হামলা হতে পারে।’ তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম এ হামলার জন্য ইসলামিক স্টেট (আইএস)-কে দায়ী করেছেন। তবে এখনও কেউ এই হামলার দায় স্বীকার করেনি। ওই হামলায় ৪১ জন নিহতের কথা নিশ্চিত করেছেন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী।
ইস্তাম্বুলের গভর্নর ভাসিপ শাহীন তুরস্কের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা টিআরটিকে জানান, প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে ধারণা করা হচ্ছে যে, মঙ্গলবার রাতের দুটি হামলায় তিনজন সন্ত্রাসী অংশ নিয়েছিল।
তুরস্কের এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, হামলাকারীরা বিমানবন্দরের অ্যারায়েভাল হলের প্রবেশমুখের একটি চেক পয়েন্টে পৌঁছলে তাদের আটকাতে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। এ সময় দুই হামলাকারী নিজেদেরকে উড়িয়ে দেয়।
বিচারমন্ত্রী বেকির বোজদাগ পার্লামেন্টে বলেন, ‘আমার কাছে আসা তথ্য অনুযায়ী, আতাতুর্ক বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক টার্মিনালে এক সন্ত্রাসী প্রথমে কালাশনিকভ দিয়ে গুলিবর্ষণ করে এবং তারপর বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেকে উড়িয়ে দেয়।’
একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ‘দ্বিতীয় বোমা হামলাটি ঘটেছে বিমানবন্দরে প্রবেশ পথ ‘বি’-তে। এসময় আমার চার বন্ধু নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন।’
টার্কিশ এয়ারলাইন্সের এক কর্মকর্তা জানান, ‘হামলার পর আতাতুর্ক বিমানবন্দর থেকে নির্ধারিত ফ্লাইটগুলো বাতিল করে যাত্রীদের হোটেলে ফেরত পাঠানো হয়। এর আগে ওই বিমানবন্দরের কিছু ফ্লাইট অন্য পথে সরিয়ে নেয়া হয়।’
ঘটনাস্থল থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা ছবিতে মেঝেতে এবং একটি টার্মিনাল ভবনের বাইরে আহতদের পড়ে থাকতে দেখা গেছে। টেলিভিশন ফুটেজে ঘটনাস্থলের দিকে অ্যাম্বুলেন্স ছুটে যেতে দেখা যায়।
এদিকে, হামলার পর পরই তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান দেশটির প্রধানমন্ত্রী বিন আলি ইলদিরিম, নিরাপত্তা ও সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঙ্কারায় বৈঠক করেছেন। তিনি এ হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, সন্ত্রাসীরা নিরীহ মানুষ হত্যার মাধ্যমে আবারও তাদের ‘কালো চেহারা’ উন্মোচন করেছে। তবে সিরিয়ায় কর্মরত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক মিলিটারি এ্যাটাচে লে.কর্নেল (অব.) রিক ফ্রাংকোনা বলেছেন, ‘তুরস্কের মতো দেশে বিমানবন্দরগুলোকে শতবাগ সুরক্ষিত রাখা সম্ভব নয়। কারণ দেশটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে আইএসআইএস ডুকে পড়েছে।’ উল্লেখ করার বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব যে জোট শক্তি ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসআইএসের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, জোটের অংশীদার হিসেবে তুরস্ক তাদের বিমানবন্দর ব্যবহার করতে দিয়ে জোটকে সহায়তা করছে। আইএসআইএস জঙ্গিদের রোষের কারণ এটাও হতে পারে।