পাসপোর্ট বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি : টিআইবি
রাকিব খান : দেশের সেবা খাতগুলোর মধ্যে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হচ্ছে পাসপোর্ট বিভাগ। এখানে সেবা নিতে গিয়ে প্রায় ৭৭ শতাংশ মানুষকে দুর্নীতি ও ঘুষের শিকার হতে হয়েছে। গতকাল বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ‘সেবা খাতে দুর্নীতি জাতীয় খানা জরিপ ২০১৫’ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০১৫ সালে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ আট হাজার ৮২২ কোটি টাকা। যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটের তিন দশমিক সাত শতাংশ। প্রতিবেদনে জানানো হয়, উচ্চ আয়ের তুলনায় নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর দুর্নীতি ও ঘুষের বোঝা অনেক বেশি। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন টিআইবির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল, নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, উপনির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া খায়ের প্রমুখ। সরকারি সেবা নিতে গিয়ে প্রতি তিনজনের দুইজনকেই কোনো না কোনোভাবে ঘুষ দিতে হয় বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)। সংস্থাটি জানিয়েছে, ঘুষ দিতে বাধ্য মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। গত তিন বছরে ঘুষ বেড়েছে প্রায় ছয় গুণ।
বাংলাদেশের সরকারি সংস্থার দুর্নীতির বিষয়ে জার্মানের বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআই-এর বাংলাদেশ শাখার এক প্রতিবেদনে একথা বলা হয়।
এতে বলা হয়, ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে ঘুষ বেড়েছে প্রায় ছয় গুণ। সংস্থাটির জরিপ অনুযায়ী ২০১২ সালে সরকারি সেবা নিতে গিয়ে মানুষকে ঘুষ দিতে হয়েছিল প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। আর ২০১৫ সালে ঘুষ দিতে হয়েছে আট হাজার ৮২১ কোটি টাকা।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পাসপোর্ট ও বিচারিকসহ ১৬টি খাতে এই ঘুষ লেনদেন হয়েছে বলে জানায় সংস্থাটি। তাদের মতে, ঘুষের পরিমাণ বাংলাদেশের বাজেটের ৩.৭ শতাংশ।
বাংলাদেশের কোন কোন খাতে বেশি দুর্নীতি হয় সে তথ্য বের করতেই এই জরিপ করা হয় বলে জানিয়েছে টিআইবি। সংস্থাটির গবেষণা বলছে, সরকারি সেবা নিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকারহ হয় পাসপোর্ট অফিসে। পাসপোর্ট নিতে আসাদের প্রতি পাঁচজনের চারজনকেই ঘুষ দিতে হয়েছে বলে দাবি করেছে টিআইবি। তাদের গবেষণা মতে, পাসপোর্টের পর মানুষ সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা। আর শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষকে বেশি ঘুষ দিতে হয় বলে জানান টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, তাদের গবেষকরা দেখেছেন ঘুষ না দিলে ৭১ শতাংশ মানুষ তাদের প্রাপ্য সেবা পান না।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘গ্রামের মানুষকে বেশি ঘুষ দিতে হয় এর কারণ তাদের তথ্যের অভাব। সেভাবে সচেতনও নন তারা। তাদের ধারণা টাকা না দিলে কাজ হবে না। শহরের মানুষের তুলনায় তারা কিছুটা সহজ-সরল। তাই তাদের চাপ দেওয়া বা ফাঁদে ফেলা সহজ হয়।’
টিআইবির দাবি, শহরের চেয়ে গ্রামে দুর্নীতির প্রকোপ বেশি। শহরে সরকারি সেবা খাতে দুর্নীতির হার ৬২.৬ শতাংশ। যেটা গ্রামে ৬৯.৫ শতাংশ। একইভাবে সরকারি সেবা নিতে গিয়ে শহরে ঘুষ দিতে বাধ্য হয় ৫৩.৪ শতাংশ মানুষ। আর গ্রামে এ হার ৫৯.৬ শতাংশ।
জরিপে দেখা গেছে, পাসপোর্টে ভোগান্তি বেশি হলেও টাকার অংকে সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয়েছে গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে প্রতিটি পরিবার গড়ে ঘুষ দিয়েছে ২৭ হাজার টাকারও বেশি।
টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, বাংলাদেশের মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে দুর্নীতি। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যেন সৎ জীবনযাপন করাই সম্ভব নয়। এটা আমাদের নৈতিকতার জন্য এক বড় হামলা।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৯৯৭ সাল থেকে টিআইবি এ পর্যন্ত সাতটি খানা জরিপ করেছে। সর্বশেষ ২০১২ সালে এ জরিপ করা হয়েছিল। আর ২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে গত অক্টোবর পর্যন্ত সেবার ওপর ভিত্তি করে গত ১ নভেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এবারের জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এর আওতায় ১৫ হাজার ২০৬টি খানা ছিল, যা দেশের মোট খানার ২১০০ ভাগের এক ভাগ।
সরকারের যেসব সংস্থার সেবা মানুষ সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করে এমন ১৬টি সংস্থার ওপর চালানো হয় এ জরিপ। এর মধ্যে ছিল স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমি প্রশাসন, কৃষি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা, বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং, কর ও শুল্ক, এনজিও, পাসপোর্ট, গ্যাস, বিআরটিএ ও বিমা। এছাড়া ‘অন্যান্য’ নামে ওয়াসা, বিটিসিএল ও ডাকের সেবা খাতকে বিবেচনায় নেওয়া হয় জরিপে।
কিছু খাতে পরিস্থিতির উন্নতি
টিআইবির গবেষণা বলছে, তাদের গবেষণা চলাকালে তিন বছরে ঘুষের টাকার অংক প্রায় ছয় গুণ বাড়লেও বেশকিছু খাতে দুর্নীতি কমেছে। এর মধ্যে আছে ভূমি প্রশাসন, বিচারিক সেবা, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিং ও এনজিও। তবে স্থানীয় সরকার, বিদ্যুৎ ও বিমা খাতে দুর্নীতি তিন বছরে বেড়েছে বলে জরিপে অংশগ্রহণকারীরা জানিয়েছেন। আর শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, কৃষি, কর ও শুল্ক খাতে দুর্নীতির প্রকোপ পাল্টায়নি খুব একটা।
টিআইবির গবেষণা বলছে, স্বাস্থ্য, বিচারিক সেবা, ভূমি প্রশাসনসহ ছয়টি খাতে ঘুষের শিকার খানার হার ২০১২-এর তুলনায় কমেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, সরকার বেশকিছু ব্যবস্থা নেওয়ায় কোনো কোনো খাতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এতেই প্রমাণ হয় সরকার উদ্যোগী হলে দেশে দুর্নীতির প্রকোপ কমবে, আরও ভালো সেবা পাবে মানুষ। সম্পাদনা : রাশিদ রিয়াজ