কিলারকে ৭ লাখ টাকার প্রলোভন বাবুলকে মোবাইল ফোনে জানায় ‘বস ফিনিশড’
বিপ্লব বিশ্বাস : নগদ ৭ লাখ টাকা পুরস্কারের প্রলোভন দখিয়ে খুন করা হয় পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে। এই খুনের সঙ্গে এসপি বাবুল আক্তার নিজেই জড়িত বলে তথ্য প্রমাণ রয়েছে পুলিশের হাতে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিভিন্ন পুলিশ সূত্রগুলোতে অনুসন্ধান চালিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে সূত্রগুলো কেউই তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি। সূত্রগুলো বলেছে, সোর্স মুসার অনিন্দ্য সুন্দরী স্ত্রীর সঙ্গে এসপি বাবুল আক্তারের পরকীয়ার সম্পর্ক ছিল। প্রায়শই তিনি মুসার স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। পরবর্তীতে এই অবৈধ সম্পর্কের বিষয়টি জেনে ফেলেন তার স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। এ নিয়ে দাম্পত্য জীবনে স্বামী বাবুল আক্তারের সঙ্গে মিতুর অশান্তি শুরু হয়। পরকীয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায়শই তাদের মধ্যে কলহ লেগেই থাকতো।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, পথের কাঁটা সরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যেই বাবুল আক্তার তার স্ত্রী মিতুকে খুনের সিদ্ধান্ত নেন। এই খুনের দায়িত্ব দেন তার দীর্ঘদিনের সোর্স মুসাকে। সোর্স মুসা বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে চিনতেন না। এসপি বাবুল আক্তার মুসাকে জানান,‘একজন মহিলা জঙ্গী তৎপরতায় লিপ্ত। সে প্রতিদিন ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যায়। ওইসময় তাকে খুন করতে হবে। তা না হলে চট্টগ্রামে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যাবে। এই খুনের জন্য সরকারের তরফে ৭ লাখ টাকা পুরস্কার দেয়ারও প্রলোভন দেখানো হয় সোর্স মুসাকে। সূত্রগুলো বলেছে, টাকার লোভে মুসা কথিত জঙ্গি মহিলাকে খুন করতে রাজী হয়ে যায়। সে মোতাবেক মুসা তার পরিচিত ভাড়াটে কিলার ওয়াসিম, নবী, আনোয়ার, এহতেশাম ভোলা, শাহজাহান, কালু ও মনিরকে নিয়ে খুনের পরিকল্পনা করে। ঘটনার ১৫ দিন আগে সোর্স মুসার বাসায় মিতুকে খুনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে কিলার গ্রুপটি। কিলিং মিশনে কে কি দায়িত্ব পালন করবে সে সম্পর্কেও মুসা দিক-নির্দেশনা দেয় কিলার গ্রুপটিকে। বৈঠক শেষে প্রত্যেক কিলারকে নগদ ২ থেকে ৩ হাজার টাকা দেয় মুসা।
বন্দরনগরীর পুলিশ সূত্রগুলো আরও বলেছে, খুনের আগের দিন সকালে মুসা চট্টগ্রামের জিইসি মোড়ে মিতুকে রেকি করতে যায়। গত ৫ জুন রোববার খুনের দিনক্ষণ ঠিক করে কিলাররা। ভোলা কিলার গ্রুপটিকে অস্ত্রের জোগান দেয়। পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ায় মুসা ৪ জুন শনিবার দিবাগত রাত আড়াইটায় ঢাকায় এসপি বাবুল আক্তারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে। ওইসময় বাবুল আক্তার অন্য একটি সেল টেলিফোন থেকে মুসার সঙ্গে কথা বলে। সূত্রগুলো বলেছে, এসময় মুসা কিভাবে মিতুকে মারা হবে তার একটি ছকও বাবুল আক্তারকে বলে। বাবুল আক্তার ‘ঠিক আছে’ বলে টেলিফোন লাইন কেটে দেয়। পরিকল্পনা মোতাবেক মুসা একটি মোটরসাইকেলে করে ঘটনাস্থল চট্টগ্রাম জিইসি’র মোড়ে যায়। সেখানে মিতুর জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকে। অন্যদিকে অপর কিলার গ্রুপটি রাস্তার অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে মূল অপারেশনে থাকা অপর মুসার নেতৃত্বে থাকা অপর কিলার গ্রুপটিকে কভার দিতে থাকে। মিতু সকালে ছেলেকে নিয়ে বের হওয়া মাত্রই কিলার গ্রুপের সদস্য নবী উপর্যরি ছুরিকাঘাত করে তাকে রাস্তায় ফেলে দেয়। এসময় ওয়াসিম মিতুকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই মারা যান এসপি’র স্ত্রী মিতু।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, কিলিং মিশন শেষ হওয়ার পর মুসা বাবুল আক্তারকে মোবাইল ফোনে জানিয়ে দেয়, ‘বস ফিনিশড’। বাবুল আক্তার এসময় ‘ওকে’ বলে ফোনের লাইন কেটে দেন।
বন্দরনগরীর সূত্রগুলো বলেছে, মুসাসহ কিলার গ্রুপের কেউই জানতো না যে, তাদের টার্গেটকৃত মহিলা এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী। খুন হওয়ার পর তারা ঘটনাটি জানতে পারে। এরপরই কিলাররা গা ঢাকা দেয়। হত্যাকা-ের পরই খুনিদের শনাক্ত করতে মাঠে নামে গোয়েন্দারা। কিন্তু তারা তাৎক্ষণিক কিলারদের শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়।
ঘটনার সময় চট্টগ্রাম মহানগর বন্দর থানার ওসি মহিউদ্দিন সেলিম ব্যক্তিগত কাজে সিঙ্গাপুরে ছিলেন। তিনি দেশে ফেরার পর পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে ডেকে পাঠান। মহিউদ্দিন সেলিম দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম বেল্টে ওসি’র দায়িত্ব পালন করেছেন। অপরাধ জগতের অনেক হোতাকেই তিনি চিনতেন। পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ওসি মহিউদ্দিন সেলিমকে খুনিদের শনাক্ত করার ব্যাপারে ডিবিকে সহযোগিতা করতে বলেন। এরপরই মহিউদ্দিন সেলিম মাঠে নামেন। সপ্তাহ খানেক আগে বন্দরনগরী থেকে প্রথম আটক করা হয় কিলার গ্রুপের নেতা মুসাকে। তার আটকের ঘটনাটি এসপি বাবুল আক্তার জানতে পারেন। তিনি মুসাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য ওসি মহিউদ্দিন সেলিমকে বলেন। এসময় মহিউদ্দিন সেলিম বাবুল আক্তারকে জানান, ‘স্যার, আমি একটি অভিযানে ব্যস্ত আছি, আপনাকে পরে ফোন দিচ্ছি।’
পরে মুসাকে জিজ্ঞানাবাদ করে মিতুর কিলার বলে পরিচিত নবী, আনোয়ার, ওয়াসিম, মনির, এহতেশামুল ভোলাসহ অন্যান্য কিলারদের ধরা হয়। কিলার গ্রুপের নেতা মুসা চট্টগ্রাম গোয়েন্দা পুলিশকে জানায়, তারা এসপি বাবুল আক্তারের নির্দেশে মিতুকে খুন করেছে। নিহত মহিলা যে এসপির স্ত্রী একথা তারা জানতেন না। জিজ্ঞাসাবাদে মুসা আরও বলেছে,‘ যে মহিলাকে তারা খুন করেছে সে মহিলা জঙ্গি গোষ্ঠীর নেত্রী বলে বাবুল আক্তার তাদের জানিয়েছিল। এই জঙ্গি নেত্রীকে খুনের জন্য সরকারের তরফ থেকে ৭ লাখ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে বলে এসপি বাবুল আক্তার তাদের প্রলোভন দেখিয়েছিল। এসব তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পরই পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা বৈঠকে বসেন। তারা বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করেন। সরকারের নীতি নির্ধারক মহলকেও ঘটনাটি জানানো হয়। পুলিশের ওই বৈঠকে পর্যালোচনা করা হয় এসপি বাবুল আক্তারের ঘটনাটি জনসমক্ষে প্রকাশিত হলে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি একেবারেই বিনষ্ট হবে। এতে সরকারও বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে বাবুল আক্তারকে হত্যার দায় থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে পুলিশ বাহিনী থেকে বের করে দিতে হবে। এরপরই গত রোববার মধ্যরাতে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গোয়েন্দা দফতরে নেয়া হয়। সেখানে তিনজন ডিআইজি পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তা তাকে মিতু হত্যায় জড়িত বিষয়ে তাদের কাছে প্রমাণ থাকার কথা জানান। এসময় ডিআইজিরা বাবুল আক্তারকে বলেন, স্ত্রী হত্যায় তার জড়িত থাকার বিষয়ে তাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ রয়েছে। এরপর তাকে পুলিশ বাহিনী থেকে সরে যেতে অন্যথায় জেলে যাওয়ার প্রস্তাব করা হয়। এসময় বাবুল আক্তার পুলিশ বাহিনী ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা জানালে তাকে পুলিশের ডিসির গাড়িতে করে খিলগাঁও থানাধীন মেরাদিয়ায় তার শ্বশুর বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হয়।
গত সোমবার চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম হারুন অর রশিদের আদালতে ওয়াসিম ও আনোয়ার যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে সেখানে তারা দুজনেই বলেছে, জঙ্গি অপবাদ দিয়ে তাদের ওই মহিলাকে খুন করানো হয়েছিল। তারা জানতেন না নিহত মহিলা এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী। চট্টগ্রাম গোয়েন্দা পুলিশ ইতিমধ্যেই এসপি বাবুল, সোর্স মুসার কললিষ্ট ও কথোপকথনের রেকর্ড সংগ্রহ করেছে। সম্পাদনা: বিশ্বজিৎ দত্ত